No Confidence Motion

অনাস্থার জবাবি বক্তৃতায় লোকসভা ভোটের প্রচারের সুর বেঁধে দিলেন মোদী, পেলেন ‘বিরোধীশূন্য জয়’

গত ২০ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বাদল অধিবেশনে বিরোধীদের দাবি সত্ত্বেও মণিপুরের গোষ্ঠীহিংসা নিয়ে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার যখন তিনি মুখ খুললেন, প্রশ্ন তোলার জন্য সভায় ছিলেন না বিরোধীরা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ২৩:৪৩
Graphical representation

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে বিরোধীশূন্য লোকসভায় ধ্বনিভোটে জয় হল নরেন্দ্র মোদী সরকারের। আর বৃহস্পতিবার সেই অনাস্থা বিতর্কের জবাবি বক্তৃতায় ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের সুর বেঁধে দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বস্তুত, মোদীর ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বক্তৃতার বড় অংশ জুড়েই ছিল নিজের সরকারের ‘সাফল্যের’ দাবি এবং জওহরলাল নেহরু থেকে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীদের জমানার ‘ব্যর্থতার’ প্রসঙ্গ। মোদীর বক্তৃতায় ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত অনাস্থা প্রস্তাবের মূল আলোচ্য মণিপুরের প্রসঙ্গ না আসায় ধৈর্যচ্যূত বিরোধীরা অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। আর তার পরেই কার্যত বিরোধীশূন্য সভায় বিনা বাধায় মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে কংগ্রেসকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা-পর্ব থেকে ইউপিএ জমানা পর্যন্ত উত্তর-পূর্বের প্রতি ‘কংগ্রেসের বঞ্চনা’ নিয়ে তাঁর বক্তব্য সভার কার্যবিবরণীতে নথিভুক্ত করান। দাবি করেন, শুধু মণিপুর কেন উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে কিছু বলারই অধিকার নেই কংগ্রেসের।

Advertisement

‘ইন্ডিয়া’র দাবি ছিল, মণিপুর নিয়ে সংসদে যাতে প্রধানমন্ত্রী মুখ খোলেন, সেই উদ্দেশ্যেই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে। বস্তুত, গত ২০ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বাদল অধিবেশনে বিরোধীদের বার বার দাবি সত্ত্বেও এক বারও মণিপুরের গোষ্ঠীহিংসা নিয়ে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার যখন তিনি মুখ খুললেন, প্রশ্ন তোলার জন্য সভায় ছিলেন না বিরোধীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলেছেন, পরিকল্পনা মাফিক বক্তৃতায় প্রথম দেড় ঘণ্টায় এক বারও মণিপুর প্রসঙ্গ না তুলে বিরোধীদের অধৈর্য করে তুলেছেন মোদী। তাঁর লক্ষ্য ছিল, পরবর্তী সময় কার্যত বিরোধীশূন্য পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করা। এবং সেই লক্ষ্যে তিনি সফল।

বক্তৃতায় গোড়াতেই আত্মবিশ্বাসী মোদী বলেছেন, ‘‘ভগবান চান এনডিএ ২০২৪ সালেও সরকার গঠন করুক ভারতে। তার জন্যই তিনি বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে এই সুযোগ করে দিয়েছেন আমাদের।’’ আর সমাপ্তিপর্বে অনাস্থা প্রসঙ্গে বিরোধীদের কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আপনাদের ধন্যবাদ। আমার একটা কথা অন্তত শুনেছেন। ২০১৮ সালে আমি আপনাদের বলেছিলাম ২০২৩-এ অনাস্থা আনার জন্য।’’ প্রসঙ্গত, প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সংসদের বাদল অধিবেশনেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। সেই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিল কংগ্রেস-সহ কয়েকটি বিজেপি-বিরোধী দল। বিজেপির সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধীদের আনা প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছিল।

২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জয়ের হ্যাটট্রিক করবে বলেও দাবি করেছেন মোদী। সেই সঙ্গে বিরোধীদের ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন ২০১৮ সালে ফের অনাস্থা প্রস্তাব আনার। বস্তুত বৃহস্পতির বিকেলে তাঁর বক্তৃতায় ছত্রে ছত্রে ছিল বিরোধীদের প্রতি শ্লেষ। কখনও ট্রেজারি বেঞ্চের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘আপনাদের একটা গোপন কথা বলি, ঈশ্বরের কাছে এক অদ্ভুত বর পেয়েছেন বিরোধীরা। ওঁরা যাঁদেরই খারাপ চেয়েছেন, তাদেরই ভাল হয়েছে।’’ কখনও আবার বিরোধী বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে তাঁর খোঁচা, ‘‘বিশ্ব জুড়ে ভারতের ধন্য ধন্য হচ্ছে তাতে যাতে কারও ‘নজর’ না লেগে যায় তার ব্যবস্থা করেছেন বিরোধীরাই। বিরোধীরা কালো কাপড় পরে এসে ভারতের গায়ে কালো টিকা লাগিয়ে দিয়েছেন।’’

অনাস্থা বিতর্কে বিরোধীদের নানা ‘ক্ষমতার’ কথাও বলেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁদের এক অদ্ভুত চৌম্বকশক্তি আছে। ভারতের নামে দুনিয়ায় যে যেখানে যা-ই নেতিবাচক বলুন, তা ওঁরা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করে নেন। শুধু তা-ই নয়, সেই অভিযোগ যত ছোটই হোক না কেন, তার হয়ে প্রচারও চালান।’’ বিরোধীদের ‘ক্ষমতা’র কথা বলতে গিয়ে তিনটি উদাহরণও দেন তিনি— ১. প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য হেলিকপ্টার বানাতো এইচএএল, সেই সংস্থা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করেছিল এই বিরোধীরা। সেই এইচএএল এখন আরও উন্নতি করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ২. বিরোধীরা এলআইসির নামে খারাপ কথা বলেছিল। সেই এলআইসিও সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। ৩. ২০১৮ সালে বিরোধীরা এনডিএ সরকার পড়ে যাবে বলেছিল। তার পর আরও বেশি ভোট পেয়ে এনডিএ সরকার আবার ক্ষমতায় এসেছে।

মণিপুরে মানা গান্ধীর ছবিতে!

নেহরু, ইন্দিরা, মনমোহনের জমানায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতি ধারাবাহিক বঞ্চনা হয়েছে দাবি করে মোদী বৃহস্পতিবার তাঁর আমলের ‘উন্নয়নের খতিয়ান’ পেশ করেন। তার তা করতে গিয়ে অক্লেশে মনমোহন জমানায় কাজ শুরু হওয়া আগরতলা রেল প্রকল্পের পুরো কৃতিত্বও দাবি করেন মোদী। ইউপিএ সরকারের আমলে মণিপুরে ধারাবাহিক জঙ্গি হানার ঘটনা ঘটত এমনকী সরকারি দফতরে মহাত্মা গান্ধীর ছবির টাঙানো যেত না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সমালোচনা করেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বুধবারের সেই মন্তব্যের— ‘‘মণিপুরে ভারতমাতাকে আপনারা হত্যা করেছেন।’’ মোদীর দাবি, ‘‘ওঁদের যা মনে আছে, সেটাই বলে ফেলেন। ওঁরা ভারত মাতাকে তিন টুকরো করেছেন।’’ এমনকি, ভারতকে ‘টুকড়ে টুকড়ে’ করার চক্রান্তকারীদের সঙ্গে বিরোধীরা হাত মিলিয়ে শিলিগুড়ির ‘চিকেন নেক’ বিচ্ছিন্ন করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই ভারত থেকে আলাদা করতে চায় বলে দাবি করেন তিনি। যদিও কেন ৩ মে থেকে মণিপুরে হিংসা শুরু হলেও তিনি কেন সে রাজ্যে যাননি, তার ব্যাখ্যা দেননি মোদী।

উত্তর-পূর্বে ‘কংগ্রেসের অত্যাচার’

মোদীর দাবি ১৯৬৬ সালের ৫ মার্চ কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার মিজোরামে অসহায় মানুষের উপর বায়ুসেনার বিমান পাঠিয়ে বোমাবর্ষণ করিয়েছিল। যদিও ইতিহাস বলছে, সে সময় চিনের মদতেপুষ্ট মিজো বিদ্রোহীদের ঘাঁটির উপর হামলা চালিয়েছিল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী। ১৯৮৪ সালে পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে ঘাঁটি গড়া খলিস্তানী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন ব্লু স্টার’কে বৃহস্পতিবার ‘অকাল তখতের উপর হামলা’ বলেছেন তিনি। ১৯৬২ সালে চিনা হামলার সময় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর রেডিয়ো ভাষণকেও কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘‘নেহরু সে সময় তাঁদের (অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নাগরিক) ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সমাজবাদী পার্টিকে খোঁচা দিয়ে মোদীর মন্তব্য, ‘‘রামমনোহর লোহিয়া বলেছিলেন নেহরু ইচ্ছা করেই উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন করছেন না।’’ এমনকি, ইন্দিরা গান্ধীর সময় বেআইনি ভাবে ভারত মহাসাগরের কচ্চাতিভু দ্বীপ শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বিশ্বে শীর্ষ পাঁচে ভারত

অনাস্থা বিতর্কে মোদীর মন্তব্য, ‘‘কংগ্রেসের সময় ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্বে ১১ কিংবা ১২ নম্বরে ছিল। আমাদের সরকার দেশকে বিশ্বে শীর্ষ পাঁচের তালিকায় টেনে তুলেছে, বললেন মোদী। ওঁরা হয়তো ভাবেন, এ সব এমনি এমনি হচ্ছে। যেমন ওঁরা নিজেদের শাসনকালে বসে থাকতেন, আর ভাবতেন সব নিজে থেকে হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যা করেছি, তা সম্ভব হয়েছে কঠোর শৃঙ্খলা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে।’’

Advertisement
আরও পড়ুন