Manmohan Singh

বিকশিত ভারতেও অবদান

মনমোহন সিংহ একজন সফল অর্থনীতিবিদ ছিলেন। একই সঙ্গে ‘যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী’ নেতাও। তা না হলে, অর্থনীতির দরজা খুলে দেওয়া যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ ছিল।

Advertisement
লেখা চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:০৫
মনমোহন সিংহ।

মনমোহন সিংহ। —ফাইল চিত্র।

বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার এতটাই তলানিতে ঠেকেছিল যে, আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব হত। এই পরিস্থিতি থেকে ১৯৯১ সালে ভারত আর্থিক উদারীকরণ, বিশ্বায়ন ও বেসরকারিকরণের পথে যাত্রা শুরু করে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে। ১৯৯১ সালের ‘নতুন শিল্প নীতি’ আর্থিক বৃদ্ধির জন্য জরুরি ছিল। লাল ফিতের ফাঁস সরানো, লাইসেন্স রাজ তুলে দেওয়া এবং বিদেশি লগ্নির জন্য ভারতের অর্থনীতি খুলে দেওয়ার ফলে ভারতে শিল্পায়ন ও শিল্প ক্ষেত্রে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়।

Advertisement

মনমোহন সিংহ একজন সফল অর্থনীতিবিদ ছিলেন। একই সঙ্গে ‘যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী’ নেতাও। তা না হলে, অর্থনীতির দরজা খুলে দেওয়া যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ ছিল। কারণ বহু দিনের ‘রুদ্ধদ্বার অর্থনীতি’ থেকে রাতারাতি বৈপ্লবিক হয়ে অর্থনীতির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া সহজ কথা নয়। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নে গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকার প্রভাব মনে রাখা উচিত। ভারতের কিছু দিন আগে সোভিয়েত ইউনিয়নও রুদ্ধদ্বার সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেল থেকে বেরিয়ে অর্থনীতির দরজা খোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই আর্থিক সংস্কারের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

এ কথা ঠিক যে রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার চলে না। কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে, মনমোহন সিংহ একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে আর্থিক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যাতে আর্থিক সংস্কারের ফলে রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হলে সেই ঢেউ সামলানো যায়।

মনমোহন সিংহ বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। ‘প্লেটোনিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে নেতৃত্বের বিচার করলে, এই বুদ্ধিমত্তা জরুরি। গবেষণায় উঠে আসা পরিসংখ্যান বলছে, কোনও রাজনৈতিক নেতার শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁর সরকারের সময়কালে সে দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। ফলে প্রশ্নটা তোলাই যায়, এই উচ্চশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসায় দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে তার সুফল মিলেছিল কি না? এ বিষয়ে মনমোহন সিংহের আমলে দুর্নীতির অভিযোগ, তা থেকে নতুন রাজনৈতিক আন্দোলন ও নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।

মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ দিকে তথাকথিত ‘নীতিপঙ্গুত্ব’, টাকার দরে পতন, আর্থিক বৃদ্ধির পতন দেখা গিয়েছিল। মনমোহন সিংহের সময় নাগরিক সমাজ, বিচারবিভাগের সক্রিয়তাও তুঙ্গে উঠেছিল। একই সঙ্গে নাগরিক দাবি থেকে কী ভাবে সরকারি নীতি তৈরি হয়, মনমোহনের আমলে তারও সাক্ষী থেকেছে ভারত। একশো দিনের কাজ বা রোজগার গ্যারান্টি, তথ্যের অধিকার আইন তার প্রমাণ। মনমোহনের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উল্লেখ বিশেষ ভাবে করতে হয়। আর্থিক বৃদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাস্থ্য, শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া আরেকটি বিশেষত্ব।সবথেকে বড় পাওনা হল ‘নতুন কারখানা উৎপাদন নীতি’-র সূত্রপাত এবং আইনি অধিকারের ভিত্তিতে মানুষকে সুরাহা দেওয়া। আধারের মতো ডিজিটাল পরিকাঠামোর সূচনা তাঁরই আমলে।

মনমোহন সিংহের এই সব কর্মসূচি পরবর্তী সরকারও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২০৪৭-এর বিকশিত ভারতের রূপরেখাতেও তা জরুরি উপাদান হয়ে উঠবে। ভারতের উত্থানের জন্য তাই মনমোহন সিংহের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে।

(অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি, দিল্লি; মিউনিখের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্সের বোর্ড অব ম্যানেজমেন্টের সদস্য)

Advertisement
আরও পড়ুন