—গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
পটনা কিংবা বেঙ্গালুরু, মুম্বই বা দিল্লি— যখনই বিজেপি-বিরোধী দলগুলি বৈঠক করেছে, তখনই রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্ন উঠেছে যে, রাজ্যে রাজ্যে তাদের জোট কতটা পরিণতি পাবে? বিভিন্ন রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’র ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার মধ্যেও রাজনৈতিক মহলে একটা ধারণা ছিল, অন্তত চারটি রাজ্যে এই জোট কার্যকর হবে। সেগুলি হল ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র, বিহার, এবং তামিলনাড়ু। কিন্তু ঘটনাক্রম বলছে, গত এক মাস ধরে এই চার রাজ্যে বিস্তর বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বিরোধী জোটকে।
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া ইস্তক হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতার করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। মহরাষ্ট্রে কংগ্রেসের ভাঙন অব্যাহত। এক মাসের মধ্যে তিন জন নেতা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি এবং অজিত পওয়ারের এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন। বিহারে নীতীশ কুমারের ডিগবাজিতে ফের বিজেপি-জোট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। সোমবার আস্থাভোটেও জিতে গিয়েছেন নীতীশ। পাশাপাশিই, এনফোর্সমোনেট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে গ্রেফতার হওয়া তামিলনাড়ুর ডিএমকে নেতা তথা মন্ত্রী সেন্থিল বালাজি মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। মঙ্গলবার রাজ্যপাল এন রবি তা গ্রহণও করেছেন। যাকে সামগ্রিক ভাবে এমকে স্ট্যালিনের জন্য ‘রাজনৈতিক ধাক্কা’ হিসাবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
বিহারের ক্ষেত্রে নীতীশ শুধু ডিগবাজি খেয়েছেন তা-ই নয়, বিরোধী শিবিরের মধ্যেও অবিশ্বাসের বাতাবরণ কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে সোমবারের পর থেকে। সোমবার ছিল বিহার বিধানসভায় আস্থাভোট। তাতে দেখা যায়, আরজেডির তিন বিধায়ক ট্রেজারি বেঞ্চ তথা শাসকপক্ষের দিকে ভিড়ে গিয়েছেন। রবিবারেও আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব বলেছিলেন, ‘‘খেলা হবে!’’ কিন্তু বিধানসভায় তেজস্বীর বর্ণিত ‘খেলা’ হয়নি। নীতীশ বিরোধী জোট থেকে এনডিএ-এর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। গত বছর জুন মাসে এই নীতীশেরই পটনার বাড়িতে বিরোধী জো়টের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল। যদিও তখনও ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণ হয়নি।
মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে চারটি ঘটনা বিরোধী জোটকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। মিলিন্দ দেওরা, বাবা সিদ্দিকি এবং সর্বশেষ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বন কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে মিলিন্দ আগেই যোগ দিয়েছিলেন বিজেপির জোটসঙ্গী শিবসেনা (একনাথ শিন্ডে)-য়। মঙ্গলবার পদ্মশিবিরে শামিল হয়েছেন অশোক। বাবা যোগ দিয়েছেন অজিত পওয়ারের এনসিপিতে। বস্তুত, এটা যদি কংগ্রেসের পক্ষে ধাক্কা হয়, তা হলে একই ভাবে ধাক্কা খেয়েছেন শরদ পওয়ারও। দলের নাম এনসিপি ও প্রতীক ‘ঘড়ি’ পওয়ারের হাতছাড়া হয়েছে। সেটি পেয়েছেন ভাইপো অজিত। বস্তুত, আগেই একনাথ শিন্ডে বেরিয়ে যাওয়ার পরে শিবসেনার নাম ও প্রতীক হাতছাড়া হয়েছিল দলের প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র উদ্ধব ঠাকরের। মারাঠা মুলুকে গত বিধানসভা ভোটের পর যে ভাবে বিজেপিকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস এবং এনসিপিকে নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন উদ্ধব, তা ছিল ‘মাইলফলক’। কিন্তু মধ্য মেয়াদেই তা ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। সৌজন্যে: শিন্ডেবাহিনী।
তাও ঝাড়খণ্ডের অবস্থা মন্দের ভাল। সেখানে হেমন্ত জেলে গেলেও ক্ষমতায় থাকা জোট কুর্সি ধরে রাখতে পেরেছে। আস্থাভোটে জয়ী হয়েছেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার চম্পই সোরেন। তাঁকে রাজভবনে ডাকা না ডাকা নিয়েও রাঁচিতে টানটান নাটক হয়েছিল। যদিও লোকসভায় জোট কতটা অটুট থাকবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন রয়েছে।
এর পরে তামিলনাড়ু। গত বছর জুন মাসে বেআইনি আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত মামলায় ইডি গ্রেফতার করেছিল স্ট্যালিনের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য বালাজিকে। তার পরেই চেন্নাই রাজভবন তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্ট্যালিন মন্ত্রিসভা থেকে না সরিয়ে বালাজিকে ‘দফতরহীন’ মন্ত্রী করে রেখেছিলেন। সেই সময়ে সরকারের বিষয়ে রাজ্যপালের ‘নাক গলানো’ নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন। কিন্তু সেই বালাজি আচমকাই সোমবার মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফাপত্র পাঠান রাজভবনে। কেন? কারণ, সামনেই তাঁর জামিনের মামলার শুনানি রয়েছে। অনেকের মতে, ‘প্রভাবশালী’ তকমা ঝেড়ে ফেলতেই এই পদক্ষেপ। তবে সামগ্রিক ভাবে ওই ঘটনাকে তামিল রাজনীতিতে অনেকেই স্ট্যালিনের জন্য ‘ধাক্কা’ হিসাবে দেখছেন। কারণ, স্ট্যালিনই বালাজিকে মন্ত্রিসভায় রেখে দিয়েছিলেন।
সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ গঠনের পর থেকেই প্রশ্ন ছিল পঞ্জাব, দিল্লিতে কি আদৌ কংগ্রেসের সঙ্গে আম আদমি পার্টির জোট হবে? উত্তরপ্রদেশেই বা কতখানি জমাট বাঁধবে জোট? ইতিমধ্যেই বাংলায় জোট নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের তিক্ততা চূড়ান্ত আকার নিয়েছে। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে কংগ্রেসের কী সমীকরণ দাঁড়াবে, তা নিয়েও সন্দিহান অনেকে। তবে যে চারটি রাজ্যে জোট সবচেয়ে বেশি জমাট বাঁধতে পারত এবং বিজেপিকে বেগ দিতে পারত বলে অনেকে অনুমান করেছিলেন, সেই চার রাজ্যেই গত এক মাসে বিবিধ ধাক্কা খেতে হয়েছে কংগ্রেস, শিবসেনা, জেএমএম, আরজেডি, ডিএমকে-র মতো দলগুলিকে।