হাতে হাত রাহুল গান্ধী-সীতারাম ইয়েচুরির। ছবি: সংগৃহীত।
হাতে হাত ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা দু’জন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। শনিবার বেঙ্গালুরুতে। সে রাজ্যের নতুন কংগ্রেস সরকারের শপথ কর্মসূচিতে। লোকসভা ভোটের আগে এই ছবি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
জাতীয় স্তরে অবশ্য অনেক দিনই দু’দল ‘কাছাকাছি’। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার মতো একদা ‘লালদুর্গে’ ভোট-সহযোগীও। যদিও কর্নাটকে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে এ বারের লড়াইয়ে ‘হাত’-এর পাশে ছিল না ‘কাস্তে-হাতুড়ি-তারা’। বরং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার জেডিএসের সঙ্গে সমঝোতা করে চারটি আসনে তারা লড়েছিল (সবগুলিতেই অবশ্য সিপিএম হেরেছে)।
ঘটনাচক্রে, কর্নাটকের পড়শি রাজ্য কেরলেও দুই দল পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই রাজ্য থেকেই ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বাম জোটের প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন রাহুল। সিদ্দারামাইয়া-শিবকুমারদের শপথে ইয়েচুরি আমন্ত্রণ পেলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ডাক পাননি কেরলের মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা পিনারাই বিজয়ন।
ঘটনাচক্রে, সিপিএমের অন্দরের সমীকরণে বিজয়নের পরিচিতি দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে। কারাট সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন ২০০৮ সালে ভারত-আমেরিকা অসামরিক পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে মনমোহন সিংহের সরকারে উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল সিপিএম। লোকসভায় আস্থাভোটে বিজেপির সঙ্গেই মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন সিপিএম সাংসদের। আস্থাভোটের আগে স্পিকার পদ ছাড়তে রাজি না হওয়ায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কারও করা হয়েছিল।
ওই ঘটনার পরের বছর, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল কংগ্রেসের। সেই সমঝোতা বহাল ছিল ২০১১ সালে বাংলার বিধানসভা ভোটেও। ৩৪ বছরের বাম জমানার পতন ঘটেছিল সেই নির্বাচনে। ২০১৫-র এপ্রিলে কারাটের জায়গায় সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন ইয়েচুরি। তার পর থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। যার প্রথম বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে। বাম-কংগ্রেস সমঝোতায়।
ইতিহাস বলছে, ১৯৬৪ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে, বারে বারে কংগ্রেস সম্পর্কে মূল্যায়ন এবং অবস্থান বদলেছে সিপিএম। দলের প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া ষাটের দশকের মধ্যপর্বে ‘প্রধান শত্রু’ কংগ্রেসকে হারাতে জনসঙ্ঘ (বিজেপির পূর্বসূরি), মুসলিম লিগ-সহ সমস্ত দলের সঙ্গে সমঝোতার সওয়াল করেছিলেন। আবার ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের ভাঙনের সময় তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ‘প্রগতিশীলতার ছায়া’ দেখেছিলেন!
১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারির পরে বহু দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ হলেও সিপিএম নিষিদ্ধ হয়নি। যদিও ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় তারা ছিল জনতা পার্টির সহযোগী। এমনকি, ১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে অন্ধ্রপ্রদেশের এনটি রামা রাওয়ের তেলুগু দেশমের সঙ্গে জোট হয়েছিল সিপিএম এবং বিজেপি দু’দলেরই! ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে জনতা দলের নেতা ভিপি সিংহের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন করেছিল সিপিএম এবং বিজেপি দু’পক্ষই।
পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের সঙ্গেই এইচডি দেবগৌড়া এবং আইকে গুজরালকে প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন জানিয়েছিল সিপিএম। ২০০৪-এর লোকসভা ভোটের পরে আবার সরাসরি সমর্থন করেছিল কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। বস্তুত, সিপিএম-সহ বাম দলগুলির সমর্থনের জোরেই সে বার সরকার গড়তে পেরেছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট। পরমাণু চুক্তি নিয়ে ‘বিশ্রী রকমের’ বিচ্ছেদের পর, একাধিক রাজ্যে কংগ্রেস-সিপিএম নির্বাচনী জোট হলেও, সর্বভারতীয় স্তরে আর কোনও সমঝোতা হয়নি। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে রাহুল-ইয়েচুরির ‘করমর্দন’ কি বাংলা, ত্রিপুরার পরিসর ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরেও পারস্পরিক ঐক্যের বার্তাবাহী?