গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
নিহত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সেই মন্তব্যকে হাতিয়ার করেই দুর্নীতি নিয়ে কংগ্রেসকে নিশানা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে রাহুল গান্ধীর দলকে খোঁচা দিলেন ইন্দিরা গান্ধীর স্লোগানের প্রসঙ্গ তুলে।
১৯৮৫ সালে রাজীব বলেছিলেন, ‘‘দিল্লির সরকার যদি মানুষের কল্যাণে ১ টাকা বরাদ্দ করে, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, গরিব মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে মাত্র ১৫ পয়সা।’’ মঙ্গলবার বাজেট অধিবেশনের প্রথমার্ধে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে আলোচনার জবাবি বক্তৃতায় রাজীবের সেই মন্তব্যের উল্লেখ করে কংগ্রেস সাংসদদের বেঞ্চের দিকে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন— ‘‘তখন তো দিল্লি থেকে পঞ্চায়েত পর্যন্ত এঁদেরই রাজত্ব ছিল। বাকি পয়সা কোথায় যেত?’’ প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তিনি নিজেই— ‘‘ভুল হাতে যেত।’’ সেই ‘হাত’ (ঘটনাচক্রে যা কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক) যে কংগ্রেসের, সে দিকে ইঙ্গিত করে এর পরেই তাঁর মন্তব্য— ‘‘আমি হাতের কথা বলেছি। কার হাত বলিনি।’’
রাজীবের ‘একুশ শতকের ভারত’ গড়ার স্লোগানকেও নিশানা করেছেন মোদী। আর তা করতে গিয়ে খোঁচা দিয়েছেন রাজনীতিতে আসার আগে তাঁর বিমানচালকের পেশাকে। মোদীর কথায়, ‘‘আমাদেরই এক প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় বিশ শতক, একুশ শতক বলতেন। প্রয়াত আরকে লক্ষ্মণ তা নিয়ে চমৎকার একটি কার্টুন এঁকেছিলেন— ঠেলার উপর রয়েছে একটি বিমান। বিমান বসে রয়েছেন এক পাইলট। কেন পাইলট, তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু সেই ঠেলাটিকে নিয়ে চলেছেন এক শ্রমিক। ঠেলার গায়ে লেখা রয়েছে একুশ শতক! আসলে ওই প্রধানমন্ত্রী বিংশ শতাব্দীর চাহিদাই বুঝে উঠতে পারেননি।’’
মোদীর নিশানা থেকে বাদ পড়েনি আর এক প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘গরিবি হটাও’ স্লোগানও। তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ দশক আগে থেকে দেশবাসী ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান শুনেছেন। আর এখন ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আমরা শুধু জমির অধিকারের কথা বলিনি, মানুষকে জমির অধিকার দিয়েছি। এর জন্য দূরদৃষ্টির প্রয়োজন।’’ এর পরেই বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর আসনের দিকে চেয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘কিন্তু কিছু মানুষের সেটা নেই।’’ তাঁর সরকারের দারিদ্র দূরীকরণে সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে রাহুলের উদ্দেশ্যে মোদীর খোঁচা— ‘‘যাঁরা গরিবের বাড়ি গিয়ে ফোটোসেশন করেন, সংসদে গরিবদের উন্নয়নের কথা তাঁদের কাছে পানসে লাগবে।’’
যে কাজ ৪০-৫০ বছর আগে (কংগ্রেসের আমলে) হওয়ার কথা ছিল, তা তাঁর সরকারকে এখন করতে হচ্ছে বলে মঙ্গলবার লোকসভায় জবাবি বক্তৃতায় দাবি করেন মোদী। জানান, তারই জমানায় সরকারি আবাসন প্রকল্পে চার কোটি বাড়ি নির্মিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে ১২ কোটি শৌচাগার। পরিকাঠামো উন্নয়নে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে (ইউপিএ জমানায়) বরাদ্দ ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১১ লক্ষ কোটি। সরকারি অপব্যবহার বন্ধ করে তাঁর সরকার ৩ লক্ষ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে বলেও দাবি প্রধানমন্ত্রীর। সেই সঙ্গে বিরোধীদের জাতগণনার দাবিকে ‘ফ্যাশন’ বলে খোঁচা দিয়ে মোদীর মন্তব্য, ‘‘ভুলে যাবেন না, অটলবিহারী বাজপেয়ীজির সময়ই প্রথম আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রক গঠিত হয়েছিল।’’
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগান তুলেছিলেন মোদী। সোমবার তাঁর গলায় শোনা গেল ‘তুষ্টি-সন্তুষ্টি’ তত্ত্বের মোড়কে সেই প্রসঙ্গের উল্লেখ। মোদীর দাবি, বিরোধীরা তুষ্টিকরণের (মুসলিম তোষণের) রাজনীতি করছেন, আর তাঁর সরকার চাইছে সন্তুষ্টিকরণ— জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতবাসীর উন্নয়ন। রাহুলকে নিশানা করে মোদীর মন্তব্য, ‘‘যাঁরা সংবিধান বুকে নিয়ে ঘোরেন তাঁরা মুসলিম মহিলাদের দুর্দশা দেখতে পেতেন না। আমরা তিন তালাক প্রথা বাতিল করে মুসলিম মহিলাদের স্বস্তি দিয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, ‘‘যাঁরা পিছিয়ে রয়েছে, তাঁদের দিকে প্রথমে নজর দিতে হবে।’’ বিজেপি ‘বিষের রাজনীতি’ করে না বলেও দাবি করেছেন তিনি।
মোদীর নিশানা থেকে বাদ পড়েননি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং রাহুলের মা সনিয়া গান্ধীও। সংসদে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বক্তৃতার পরে সনিয়ার মন্তব্যের জেরে ইতিমধ্যেই স্বাধিকারভঙ্গের নোটিস দিয়েছে বিজেপি। প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রীর নাম না করে মোদী বলেন, ‘‘এক মহিলা আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে অপমান করেছেন।’’ অন্য দিকে, তাঁর সরকারের বিদেশনীতি (মূলত আমেরিকা এবং চিনের ক্ষেত্রে) সম্পর্কে রাহুলের সোমবারের বক্তৃতার জবাব দিতে পঞ্চাশের দশকে নেহরু এবং আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডির সম্পর্ক নিয়ে লেখা একটি বইয়ের প্রসঙ্গ টানেন মোদী। বিরোধী দলনেতার চেয়ার লক্ষ্য করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বইটি পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, দেশ যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত, তখন বিদেশনীতির নামে কোন খেলা চলছিল।’’
আর বুধের দিল্লি ভোট? খাতায়-কলমে সোমবার বিকেল ৫টায় প্রচারের সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও সংসদীয় রক্ষাকবচের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁরই সরকারের আমলে দিল্লিতে মেট্রোর পথ দ্বিগুণ হয়েছে, কেন্দ্রের অর্থে কয়েক হাজার দূষণমুক্ত ইলেকট্রিক বাস চলাচল শুরু হয়েছে বলে দাবি করলেন তিন। সেই সঙ্গে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ আম আদমি পার্টি (আপ)-র প্রধান অরবিন্দ কেজরীওয়ালেন নাম না নিয়ে বললেন— ‘‘আমরা মানুষের টাকা মানুষের উন্নয়নে খরচ করেছি। নিজেদের জন্য শিশমহল বানাইনি।’’
বিরোধী নেতাদের একাংশ ‘নকশালদের সুরে কথা বলেন’ বলেও মঙ্গলের জবাবি বক্তৃতায় অভিযোগ করেন মোদী। দিল্লিতে নেহরু সংগ্রহশালার নাম বদল প্রসঙ্গে সনিয়া-রাহুলদের আপত্তিকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার বলেন, ‘‘দিল্লিতে অনেক জায়গা দেখতে পাবেন, যেখানে পারিবারিক মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। কিন্তু আমরা পিএম মিউজিয়াম বানিয়েছি। যেখানে দেশের সব প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তথ্য থাকছে। আমি চাই প্রধানমন্ত্রীদের পরিবার সেই মিউজিয়াম ঘুরে দেখে তাঁদের পরামর্শ দিক।’’