স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাল কেল্লায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
গত বৃহস্পতিবার সংসদে অনাস্থা বিতর্কের জবাবি বক্তৃতায় ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। মোদীর ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বক্তৃতার বড় অংশ জুড়েই ছিল নিজের সরকারের ‘সাফল্যের’ খতিয়ান এবং বিরোধী কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীদের জমানার ‘ব্যর্থতার’ প্রসঙ্গ। মঙ্গলবার সকালে ভারতের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাল কেল্লায় ভাষণ দেওয়ার সময়ও একই সুর বাঁধতে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীকে। পাশাপাশি, তিনি এ-ও বুঝিয়ে দিলেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গড়বে বিজেপিই।
দেশের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার লাল কেল্লায় পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী মোদী। পতাকা উত্তোলন পর্ব সেরে বক্তৃতা করার সময় দেশবাসীকে নিজের পরিবার হিসাবে সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘‘যে সব প্রকল্পের শিলান্যাস আমি করেছি, তার উদ্বোধনও আমার ভাগ্যে লেখা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’ পরের বছর তিনি আবার লাল কেল্লায় পতাকা উত্তোলন করতে আসবেন বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ, কেন্দ্রে বিজেপিই যে আবার সরকার গড়বে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে বসবেন, নিজের মন্তব্যের মাধ্যমে কৌশলে সে কথাই কি স্পষ্ট করলেন মোদী?
প্রসঙ্গত, লাল কেল্লায় ভাষণের সময় আগের কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতার তুলনায় গত ১০ বছরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাফল্যকাহিনি বেশি শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। যার অনেকটা জুড়েই ছিল করোনা আবহে টিকাকরণ নিয়ে কেন্দ্রের ভূমিকা এবং অর্থনীতি।
মোদী বলেন, ‘‘করোনার সময় ভারত যে ভাবে কাজ করেছে, তা সারা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ২০০ কোটি টিকাকরণের কথা শুনে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে গিয়েছে। আমাদের আশাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকাকরণ করেছেন। সরকারের লক্ষ্যপূরণে সরকারি কর্মীরা সাহায্য করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘১০ বছর আগে বিজেপি সরকার গঠনের আগে ভারতের অর্থনীতির হাল খারাপ ছিল। কিন্তু গত দশ বছরে বর্তমান সরকারের চেষ্টায় বিশ্ব দরবারে ভারত পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। খুব শীঘ্রই তা তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে।’’
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের গত ১০ বছরে কাজের খতিয়ানও মঙ্গলবার দিতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। কোন প্রকল্পে কত ব্যয় করা হয়েছে, সেই হিসাবও তিনি দিয়েছেন জাতির উদ্দেশে ভাষণের সময়। তিনি বলেন, ‘‘আগের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় কেন্দ্র থেকে রাজ্যগুলিকে ৩০ লক্ষ কোটি পাঠানো হত। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা। পুরসভার বরাদ্দ ৭০ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ৩ লক্ষ কোটি হয়েছে। কেন্দ্র কৃষকদের জন্য ইউরিয়া ভর্তুকিতে প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করছে। মুদ্রা যোজনার অধীনে আত্মনির্ভর কর্মসংস্থানের জন্য যুবসমাজের হাতে ২০ লক্ষ কোটিরও বেশি তুলে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৮ কোটি মানুষ ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁরা আবার অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’’
লাল কেল্লা থেকে ‘বিশ্বকর্মা জয়ন্তী’ উপলক্ষে ‘বিশ্বকর্মা যোজনা’ চালু করার ঘোষণাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, কেন্দ্র আগামী মাসে ‘বিশ্বকর্মা যোজনা’র আওতায় স্বর্ণকার, নাপিত, ধোপা, কুমোরদের মতো শ্রমিকদের ১৩-১৫ হাজার কোটি টাকার সাহায্য করবে। কেন্দ্র গত দশ বছরে ১৩.৫ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার উপরে তুলে এনেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
লাল কেল্লা থেকে ভারতের যুবসমাজের উদ্দেশেও বার্তা দেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতে ৩০ বছরের কমবয়সিদের সংখ্যা বিশ্বের বাকি দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি। আর সেই যুবসমাজই ভারতের শক্তি। এই ভারতকে কেউ হারাতে থামাতে পারবে না।’’ ভারতের ছোট-বড় শহরগুলির যুবসমাজ প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক এগিয়ে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতে গত দশ বছরে জলশক্তি, ইন্টারনেট, সড়ক, রেল-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে বলেও জাতির উদ্দেশে ভাষণের সময় উল্লেখ করেন তিনি। করোনার পর বিশ্ব জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি হলেও ভারত সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
এর পাশাপাশি, বিরোধী কংগ্রেসের দিকে আক্রমণ শানিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে দেশের দিকে দিকে দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছিল। বহু বছরের দুর্নীতির কারণে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়েছিল।’’ বিরোধীরা পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি করছে বলেও খোঁচা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিছু দল আছে, যারা পরিবারের দ্বারা, পরিবারের জন্য এবং পরিবারের স্বার্থে চালিত হয়।’’ তোষণের রাজনীতি প্রসঙ্গেও বিরোধীদের দিকে তোপ দেগেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘দেশের উন্নয়নের জন্য ভারতকে তিনটি অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র এবং তোষণের বিরুদ্ধে আমার লড়াই জারি থাকবে।’’
মোদীর দেড় ঘণ্টার বক্তৃতায় মূলত জায়গা পেয়েছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের ‘অগ্রগতি’র কথা। পাশাপাশি বিরোধীদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী। যেমনটা শোনা গিয়েছিল গত বৃহস্পতিবার সংসদে অনাস্থা বিতর্কে মোদীর জবাবি ভাষণের সময়। তাই অনেকে মনে করছেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচার ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। যার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার লোকসভায় হয়েছিল। দ্বিতীয় ইনিংস খেললেন লাল কেল্লায়।