রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায়। পিটিআই
‘মোদী-আদানি ভাই ভাই’। ‘আদানি কি গুলামি বন্ধ করো’। ‘এলআইসি-পে কুছ তো বোলো’। ‘এসবিআই-পে কুছ তো বোলো’।
প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা ধরে রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা চলল। সওয়া এক ঘণ্টা ধরেই বিরোধী সদস্যেরা দল বেঁধে প্রধানমন্ত্রীর সামনে এই সব স্লোগান তুললেন। মোদীর সঙ্গে শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্ক, আদানিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, শেয়ার দরে কারচুপি নিয়ে আক্রমণ শানালেন। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীকে রাজ্যসভায় নজিরবিহীন বিক্ষোভের মুখে পড়তে হল। লোকসভার পরে রাজ্যসভাতেও তাঁর সরকারের আমলে আদানিদের শ্রীবৃদ্ধি, আদানিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও শেয়ার দরে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আদানি গোষ্ঠীতে এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের লগ্নি নিয়েও রা কাড়েননি।
নজিরবিহীন বিক্ষোভের মধ্যে গলা চড়িয়ে বক্তৃতা চালিয়ে যেতে তাঁকে বার বার জল খেতে হয়েছে। বক্তৃতার গোড়ায় বিরোধীদের নিশানা ভোঁতা করতে বলেছিলেন, “যত পাঁক ছুড়বেন, তত পদ্ম ফুটবে।” তাতেও লাভ হয়নি। বিরোধী শিবির থেকে উড়ে আসা কটাক্ষে বারে বারে বক্তৃতার ছন্দপতন হয়েছে। তা সত্ত্বেও বক্তৃতার শেষকালে বাঁ হাতে নিজের ছাতি ঠুকতে ঠুকতে বলেছেন, “গোটা দেশ দেখছে, এক জন একাই কত জনকে টেক্কা দিচ্ছে। বিরোধীরা পালা করে স্লোগান দিয়ে চললেও, আমি একাই এক ঘণ্টার বেশি সব আক্রমণের জবাব দিয়ে চলেছি।”
মনে করা হচ্ছে, এ সব বলে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে আদানি নিয়ে প্রশ্নের মুখে কোণঠাসা মোদী বার্তা দিতে চাইছেন, বিরোধীরা এককাট্টা হলেও তিনি একাই সবাইকে টেক্কা দেবেন। অনেকে এর মধ্যে তাঁর অহঙ্কারও দেখছেন। একের পর এক ভোটে বিজেপির জয় মোদীকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।
আগেভাগেই কৌশল করে বিরোধীরা এ দিন প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করতেই ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। বিরোধীদের এককাট্টা দেখে মোদী কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার সময় অন্য দলের সঙ্গে কী রকম আচরণ করেছিল, ইন্দিরা গান্ধী কী ভাবে ৫০ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে বিরোধী শাসিত রাজ্যে সরকার ফেলে দিয়েছিলেন, তার স্মৃতি উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও লাভ হয়নি।
একই সঙ্গে গান্ধী পরিবারকে নিশানা করে মোদী বলেন, “দেশের ৬০০ প্রকল্পে গান্ধী-নেহরু পরিবারের নাম রয়েছে। নেহরুর নামের উল্লেখ না-হলে অনেকের চুল খাড়া হয়ে যায়, রক্ত গরম হয়ে যায়। আমাদের না হয় ভুল হয়ে যায়। কিন্তু নেহরুর পরিবারের উত্তরপুরুষরা কেন নেহরুর পদবি ব্যবহার করেন না? এত কীসের লজ্জা?” রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো যাত্রায় কাশ্মীরে গিয়ে দাবি করেছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষরা কাশ্মীরি পণ্ডিত ছিলেন। সেই কারণেই মোদীর এই প্রশ্ন বলে অনেকে মনে করছেন। তবে মোদীর এই প্রশ্নকে ‘কোণঠাসা ব্যক্তির মরিয়া আক্রমণ’ হিসেবেই দেখছেন কংগ্রেস নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কার নেহরু পদবি ব্যবহারের প্রশ্নই নেই। কারণ তাঁরা নেহরু-কন্যা ইন্দিরার স্বামী ফিরোজ গান্ধীর পদবি ব্যবহার করেন।
মোদী আজ আবার দাবি করেন, ২০১৪-য় তিনি ক্ষমতায় আসার আগে কোনও কাজ হয়নি। তিনি আসার পরেই মানুষের কাছে সুবিধা পৌঁছেছে। যে কোনও প্রকল্পের সুবিধা ১০০ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা তাঁর লক্ষ্য বলে দাবি করে মোদী যুক্তি দিয়েছেন, এটাই আসল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের ‘তুষ্টিকরণ’ বা দুর্নীতির সুযোগ থাকে না। ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা ভূপেশ বঘেল প্রশ্ন তুলেছেন, “বুধবার বিকেলে মোদীজি লোকসভায় বললেন, নলবাহিত জলের সুবিধা ৮ কোটি মানুষ পেয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বললেন, ১১ কোটি মানুষের ঘরে জল পৌঁছেছে। ২১ ঘণ্টার মধ্যে ৩ কোটি মানুষ জল পেয়ে গেলেন? এই গতিতেই প্রধানমন্ত্রীর বন্ধু আদানির সম্পত্তি বেড়েছে।”
আজ রাজ্যসভায় কক্ষ সমন্বয়ের প্রশ্নে বিরোধীদের যে ঐক্য দেখা গিয়েছে তা ভবিষ্যতেও সরকার-বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বজায় থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। তিনি বলেন, “প্রায় সব বিরোধী দলই সরব ছিল। কিন্তু দুই কক্ষ মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টার বক্তব্যে যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী আদানি-প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন তা তাঁর ঔদ্ধত্যের পরিচয়।” শিবসেনা সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, “আদানি গোষ্ঠীর মুখপাত্র ও সেলসম্যান হিসাবে বছরের সেরা পুরস্কারটি প্রধানমন্ত্রীর পাওয়া উচিত।”
বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে মোদীর বক্তৃতার সময় স্লোগান তোলায় তা নিয়ে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় বিরোধী সাংসদদের কড়া নিন্দা করেছেন। আদর্শ আচরণের কথা মনে করিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পরে বাজেট নিয়ে আলোচনায় কংগ্রেসের সাংসদদের বক্তৃতার সময়ও বিজেপি সাংসদরাও ‘মোদী, মোদী’ বলে স্লোগান তোলেন। ফলে অধিবেশন মুলতুবি করে দিতে হয়। কংগ্রেসের মুখ্য সচেতক জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘২০০৪-এ বিজেপি সাংসদরা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে বিতর্কে বলতেই দেননি। আজ রাজ্যসভায় আদর্শ আচরণ নিয়ে প্রবচন শোনাচ্ছেন তাঁরা।’’ ডেরেকের অভিযোগ, মোদীর বক্তৃতার সময় বিরোধীদের বিক্ষোভ রাজ্যসভা টিভিতে দেখানো হয়নি। এ নিয়ে তাঁরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাবেন।