MCD Poll 2022 Results

ঝাড়ু উঁচিয়ে দিল্লির পুরনিগমও আপের দখলে, ১৫ বছর পর রাজধানীর পুর-ক্ষমতা হারাল বিজেপি

বিজেপি পেয়েছে ৩৯.১২ শতাংশ ভোট, যা ২০১৭ সালে ছিল ৩৬.০৮ শতাংশ। ২০১৭-এর তুলনায় ভোট বাড়লেও, বিজেপির জেতা ওয়ার্ড ১৮২ থেকে নেমে এল ১০৪-এ।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:৩২
জয়ের পর জনতার অভিবাদন গ্রহণ করছেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল।

জয়ের পর জনতার অভিবাদন গ্রহণ করছেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। ছবি— পিটিআই।

সসম্মানে লড়াই উতরে তো গেলেনই, দিল্লিতে আপের মুঠো আরও শক্ত করে ফেললেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। রাজধানীতে বিজেপির টানা দেড় দশকের পুর-শাসনকালের সমাপ্তি ঘটল সেই সঙ্গে। বিধানসভার মতো দিল্লি পুরনিগমেও শুরু হচ্ছে ঝাড়ু-রাজ। ওয়ার্ড সংখ্যার বিচারে গত বারের ভোটে আপের প্রাপ্তি ছিল ৪৮ (২৭০ আসনে ভোট হয়েছিল)। এ বার ২৫০ আসনের মধ্যে আপ জিতেছে ১৩৪টি আসন। ২০১৭-এর তুলনায় ৮৬টি বেশি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে, আপ এ বছর পেয়েছে ৪২.২ শতাংশ ভোট। ২০১৭ সালের পুরভোটে আপ ভোট পেয়েছিল ২৬.২৩ শতাংশ।

শতাংশের বিচারে ভোট বেড়েছে বিজেপিরও। তারা পেয়েছে ৩৯.১২ শতাংশ ভোট, যা ২০১৭ সালে ছিল ৩৬.০৮ শতাংশ। ২০১৭-এর তুলনায় ভোট বাড়লেও, বিজেপির জেতা ওয়ার্ড ১৮২ থেকে নেমে এল ১০৪-এ। কংগ্রেস পেয়েছে ১১.৬৪ শতাংশ ভোট। গত ভোট পেয়েছিল ২১.০৯ শতাংশ। কংগ্রেসের ওয়ার্ড ছিল ৩০। এ বার তা নেমে এল ৯-এ।

Advertisement

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

দিল্লির ভোটে আপের এই লাফ কিন্তু চমকপ্রদ। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে আপকে খালি হাতে ফিরিয়েছিলেন দিল্লির বাসিন্দারা। কিন্তু ২০২০ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁরাই দুর্দান্ত জয় এনে দিয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে। পুরনিগমে ১৫ বছরের বিজেপি শাসনকে সরিয়ে, এ বারও তাঁরা দু’হাত ভরে আশীর্বাদ দিল কেজরীওয়ালের বাহিনীকে। ভোট এবং আসন— উভয় নিরিখেই এ বার বিশাল লাফ দিল আপ।

আপের এই জয়ের পর উঠে আসছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন জাদুতে পুরনিগমের দখল সম্পন্ন করল আপ? কী কৌশলে বিজেপির মতো সংগঠিত দলকে পুরক্ষমতা-ছাড়া করলেন কেজরীওয়াল? সর্বোপরি, বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ স্লোগানকে তাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কতটা ফয়দা তুলতে পারলেন খড়্গপুর আইআইটির প্রাক্তনী?

ঘটনা হল, গত ২৪ বছর ধরে দিল্লি বিধানসভায় জয় অধরা রয়ে গিয়েছে বিজেপির। কিন্তু আপ বা কংগ্রেস, রাজ্য সরকার যার হাতেই থাক না কেন, দিল্লি পুরনিগমে বিজেপির দাপট গত দেড় দশক অটুট ছিল। এমনকি, ২০১৫-এর বিধানসভা ভোটে দিল্লিবাসী আপকে ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসন দিলেও, দু’বছর পর হওয়া পুরভোটে বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু কোন জাদুতে এ বার এমন জয় পেলেন কেজরীওয়াল, সিসৌদিয়ারা?

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

১৯৫৮-য় তৈরি হয় দিল্লির পুরনিগম। ২০১২-য় তাকে তিন খণ্ডে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। তৈরি হয় এনডিএমসি (উত্তর দিল্লি পুরনিগম), এসডিএমসি (দক্ষিণ দিল্লি পুরনিগম) এবং ইডিএমসি (পূর্ব দিল্লি পুরনিগম)। ২০২২-এর ২২ মে তিনটি পুরসভাকেই ভেঙে দিয়ে গড়া হয় দিল্লি পুরনিগম বা ‘মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অফ দিল্লি’ (এমডিসি)। সেই সময় রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওঠাপড়ার সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ বলেছিলেন, পুরনিগম পুনর্দখলের উদ্দেশেই মোদী এ কাজ করলেন। কিন্তু ভোটের ফল বলছে অন্য কথা। সম্ভবত, যে কথা হিসাবের মধ্যেই আনেননি বিজেপির কৌশলীরা।

জয়ের পর আপের দফতরে কেজরীওয়ালের সাজে খুদে।

জয়ের পর আপের দফতরে কেজরীওয়ালের সাজে খুদে। ছবি: পিটিআই

প্রথমত, গত লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকেই আপ নতুন করে কৌশল সাজিয়েছিল। বিধানসভা ধরে রাখার পাশাপাশি লক্ষ্য ছিল পুরনিগম দখলও। কেজরীওয়ালদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, রাজধানীর জনগণ কেবল মাত্র পরিষেবার জন্যেই বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন, ব্যাপারটা এতটা সরল নয়। আসলে বিজেপির রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গেও একাত্মবোধ করেন বহু মানুষ। তাই বিজেপি বা মোদীকে আক্রমণ করতে গিয়ে বিজেপির আদি ও অকৃত্রিম রাজনৈতিক গতিপথকে বিঁধতে গেলে ফল অন্য রকম হতে পারে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণে গেলেও বিজেপির সামগ্রিক হিন্দুত্বের নীতির সমালোচনা শোনা যায়নি কোনও আপ নেতার গলায়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় দিল্লিতে হিংসা হয়েছিল যে এলাকায়, সেখানে প্রার্থী দেয়নি আপ। সমর্থন করেছিল নির্দল প্রার্থীকে। অর্থাৎ, দিল্লির মতো জায়গায় আপকে ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে প্রচার করার সুযোগ পায়নি বিজেপি। তার ‘ডিভিডেন্ড’ ঢুকেছে ঝাড়ুর তহবিলেই।

দ্বিতীয়ত, বিজেপি ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের প্রচার করে গোটা দেশে। অর্থাৎ, কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যেও বিজেপির সরকার। দিল্লি পুরনিগমে বিজেপির সেই স্লোগানই নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে পাল্টা দিয়েছেন কেজরীওয়াল। আপের প্রচারের মূলমন্ত্র ছিল, রাজ্যের পাশাপাশি পুরনিগমেও থাকুক আপ। তা হলেই দিল্লির সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কেজরীওয়ালের সহায় হয়েছে দিল্লি সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সাফল্যের প্রচার। ফলে অচিরেই গতি পেয়েছে আপের ‘ডবল ইঞ্জিন’ স্লোগান। যার পাল্টা কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি।

তৃতীয়ত, জঞ্জাল সাফাই এ বারের দিল্লি পুরনিগমের ভোটে অন্যতম বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। বিজেপি ও আপ, একে অপরকে বার বার এই জঞ্জাল প্রসঙ্গেই বিঁধেছে। রাজ্য সরকার যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বুনিয়াদি বিষয়ে অসামান্য কাজের দাবি করে ঢালাও প্রচার করছে, সেখানে জঞ্জাল নিয়ে বিড়ম্বনা কেবল বেড়েইছে বিজেপির। এই পরিস্থিতিতে আপের প্রচার ছিল, ঠিক যে ভাবে দিল্লির শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আমূল উন্নতি করেছেন কেজরীওয়াল, পুরনিগমের ভার পেলে জঞ্জাল সাফাই নিয়েও তেমনই গর্ব করতে পারবেন দিল্লিবাসী। এ জন্য পরিকল্পনা কী হবে, জনসভায় দাঁড়িয়ে আপ নেতারা তারও বর্ণনা দেন।

দিল্লির পুরনিগম দখলে যাচ্ছে আপের, বেশির ভাগ বুথ ফেরত সমীক্ষায় তেমনই ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু মেলেনি যেটা, সেটা হল, আপ-ঝড়ের সামনে বিধানসভার মতোই খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে বিজেপি। ফল বলছে, মোটেই তেমন কিছু হয়নি। আপ পুরনিগম দখল করেছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপি ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবে সওয়ার হয়েও একশোর বেশি আসনে জিততে পেরেছে। তৃতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেস আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে রাজধানীর ভোট ময়দানে।

আরও পড়ুন
Advertisement