Congress

মাথায় গান্ধীদের হাত, সভাপতির লড়াইয়ে খড়্গে

গান্ধী পরিবারের বাছাই করা প্রার্থী হিসেবে মল্লিকার্জুন খড়্গে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের লড়াইয়ে নামলেন। কর্নাটকের এই প্রবীণ দলিত নেতাকেই শেষ পর্যন্ত দলের সভাপতি হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গান্ধী পরিবার।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ ০৭:১২
কংগ্রেসের সভাপতি পদের নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনয়ন দাখিল করছেন শশী তারুর (বাঁ দিকে) ও মল্লিকার্জুন খড়্গে। নয়াদিল্লিতে দলের সদর দফতরে শুক্রবার। পিটিআই

কংগ্রেসের সভাপতি পদের নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনয়ন দাখিল করছেন শশী তারুর (বাঁ দিকে) ও মল্লিকার্জুন খড়্গে। নয়াদিল্লিতে দলের সদর দফতরে শুক্রবার। পিটিআই

দশ জনপথ থেকে দশ রাজাজি মার্গ। চিত্রনাট্য মেনে সব কিছু এগোলে প্রায় চব্বিশ বছর পরে কংগ্রেস সভাপতির ঠিকানা বদলাতে চলেছে।

গান্ধী পরিবারের বাছাই করা প্রার্থী হিসেবে মল্লিকার্জুন খড়্গে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের লড়াইয়ে নামলেন। কর্নাটকের এই প্রবীণ দলিত নেতাকেই শেষ পর্যন্ত দলের সভাপতি হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গান্ধী পরিবার। যার অর্থ, সব কিছু চিত্রনাট্য মেনে এগোলে প্রায় আড়াই দশক পরে গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ কংগ্রেস সভাপতি হতে চলেছেন।

Advertisement

শুক্রবার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে মনোনয়ন পর্বের শেষ দিনে মল্লিকার্জুন খড়্গে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত বৃহস্পতিবারই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি সভাপতি নির্বাচনে লড়বেন না। আচমকা ময়দানে নামতে উদ্যত হয়েও দিগ্বিজয় সিংহ শেষবেলায় মল্লিকার্জুনকে দেখে সরে দাঁড়িয়েছেন। গহলৌত, দিগ্বিজয়ের পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ নেতাদের জি-২৩ গোষ্ঠীর মণীশ তিওয়ারি, আনন্দ শর্মা, পৃথ্বীরাজ চহ্বাণরাও আজ মল্লিকার্জুনের নাম প্রস্তাব করেছেন। নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে মোট ৩০ জনকে দিয়ে মল্লিকার্জুনের নাম প্রস্তাব করিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে, চব্বিশ বছর পরে গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে আসা সভাপতির পিছনে গোটা দল থাকছে।

শশী তারুরও শুক্রবার মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় তাঁর সমর্থকেরা স্লোগান দিয়েছেন, ‘দুনিয়া ভর মে মশহুর, শশী তারুর, শশী তারুর, কংগ্রেস কা কোহিনুর, শশী তারুর, শশী তারুর’! মনোনয়ন জমা দিয়ে তারুর বলেন, “বিভিন্ন মহলে সরকারি প্রার্থী কে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু গান্ধী পরিবার তো জানিয়েই দিয়েছে, তারা নিরপেক্ষ থাকবে। কাউকে সমর্থন করবে না।” তবে কংগ্রেসের সকলেরই মত, নির্বাচনের মাধ্যমেই দলের সভাপতি ঠিক হয়েছে, এটা প্রমাণ করতেই তারুরের প্রার্থী হওয়া। ঝাড়খণ্ডের নেতা কে এন ত্রিপাঠীও আজ মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। পরে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। গান্ধী পরিবারের আস্থাভাজন মল্লিকার্জুনই সভাপতি হতে চলেছেন।

একই ভাবে কংগ্রেস নেতারা এ কথাও মানছেন, মল্লিকার্জুন সভাপতি হলেও গান্ধী পরিবারই দলের চালিকাশক্তি থাকবে। নিয়ন্ত্রণ থাকবে সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কার হাতেই। রাহুলই যে দলের মুখ থাকবেন, তা স্পষ্ট করে দিয়ে পি চিদম্বরম জানান, এখানে দলের নেতা ও সংগঠনের সভাপতি, দু’টি বিষয় আলাদা হবে। দিগ্বিজয়ের বক্তব্য, গান্ধী পরিবারের অভিভাবকত্বেই কংগ্রেস সভাপতি কাজ করবেন। আর তারুর বলছেন, “গান্ধী পরিবারই কংগ্রেসের ভিত্তিস্তম্ভ, বিবেক, দিক্-নির্দেশক হিসেবে থাকবে।” তবে সীতারাম কেশরী সভাপতি হয়ে সংগঠনের মধ্যে যে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন অনেকে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে গান্ধী পরিবারের অনুগামীদের কাছে অপদস্থ হয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল। এ বারে অনেকের আশঙ্কা, কংগ্রেসে তিনটি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র তৈরি হতে পারে। যার একটির রাশ সনিয়ার হাতে, অন্যটি রাহুলের হাতে এবং তৃতীয়টি খড়্গের হাতে থাকবে।

কংগ্রেস সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার রাতে দলের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সনিয়া দিল্লি থেকে কেরলে থাকা রাহুলের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলেন। তার পরে তিনি প্রিয়ঙ্কার বাড়িতে যান। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এর পরে মল্লিকার্জুনের সঙ্গে কথা বলেন সনিয়া। মল্লিকার্জুনের নাম চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় শুক্রবার সকালে দিগ্বিজয় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। দিগ্বিজয় বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন। তিনি জানিয়ে দেন, খড়্গের বিরুদ্ধে লড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তিনি মনোনয়নপত্র জমা করছেন না। আগে জানলে ফর্মই তুলতেন না। গহলৌতও মল্লিকার্জুনের সঙ্গে দেখা করতে যান। তার পরে এআইসিসি দফতরে এসে মল্লিকার্জুনের নাম প্রস্তাবকারী হিসেবে সই করেন। মনোনয়ন জমা দিয়ে এআইসিসি-র সমস্ত প্রতিনিধির কাছে সমর্থন চেয়েছেন মল্লিকার্জুন। তারপরে রাজঘাটে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

মল্লিকার্জুন সভাপতি হলে সত্তরের দশকে জগজীবন রামের পরে ফের কোনও দলিত নেতাকে কংগ্রেসের শীর্ষপদে দেখা যাবে। তাঁকে সামনে রেখে দলিত ভোটব্যাঙ্কের সমর্থন কিছুটা হলেও ফিরবে বলে কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন।

সভাপতি পদে সনিয়া গান্ধীর প্রথম পছন্দ অশোক গহলৌত ছিলেন নরেন্দ্র মোদীর মতোই ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত। বিজেপি যে ভাবে ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক গ্রাস করে ফেলেছে, গহলৌতকে সামনে রেখে তা আটকানোর পরিকল্পনা ছিল কংগ্রেসের। কিন্তু তাঁর রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ সচিন পাইলটকে দেওয়া হতে পারে দেখে গহলৌত বিদ্রোহ করে বসায় তাঁর নাম বাদ চলে যায়।

কোনও ওবিসি নেতাকে সভাপতি করার পাশাপাশি হিন্দি বলয়ের নেতাকেই সভাপতি করার ইচ্ছে ছিল গান্ধী পরিবারের। উদয়পুরের চিন্তন শিবিরের পর থেকেই কংগ্রেস হিন্দিতে প্রচার, যোগাযোগে জোর দিচ্ছে। কিন্তু গহলৌত অপছন্দের তালিকায় চলে যাওয়ায় এবং দিগ্বিজয়ের নামে নানা মহল থেকে আপত্তি ওঠায় দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকের মল্লিকার্জুনকেই বেছে নিতে হয়েছে। এতে অবশ্য আগামী বছর কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া কংগ্রেস লাভবান হবে আশা করা হচ্ছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে ২০২৩-এ কর্নাটক জিতলে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পেতে পারে।

মল্লিকার্জুনের বয়স এখন ৮০ বছর। ৭৫ বছর বয়সি সনিয়ার পরে ৮০ বছরের কাউকে সভাপতি করা হলে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যাবে বলে চিন্তা ছিল। সূত্রের খবর, গান্ধী পরিবারের মধ্যে আরও কমবয়সী কাউকে সভাপতির আসনে বসানোর সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়। মল্লিকার্জুনের সঙ্গেই মহারাষ্ট্রের দলিত নেতা ৬৩ বছরের মুকুল ওয়াসনিকের নাম চিন্তাভাবনার মধ্যে ছিল। দিল্লির নেতা অজয় মাকেনের নামও উঠে আসে। মল্লিকার্জুন সভাপতি হলে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার জন্য তাঁকে সকলেই মানবেন বলে তিনি এগিয়ে যান। টানা ন’বার বিধানসভা ভোট ও দু’বার লোকসভা ভোটে জেতা মল্লিকার্জুনের নির্বাচনী অভিজ্ঞতাও তাঁর পক্ষে যায়। যদিও ৮০ বছরের এই প্রবীণ নেতা কতটা সক্রিয় ভাবে দলের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে দৌড়তে পারবেন, সে আশঙ্কা থাকছেই।

বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবিয় কটাক্ষ করে বলেছেন, “কংগ্রেস সভাপতি পদে আশি বছরের মল্লিকার্জুন খড়্গে দারুণ পছন্দ। উনি তরুণ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, কংগ্রেসের পুনরুত্থানের জন্য ঠিক যেমন চাই। ওঁকে শুধু কী ভাবে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চলতে হয়, মনমোহন সিংহের থেকে সেই নিয়মগুলো জেনে নিতে হবে। তা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”

আরও পড়ুন
Advertisement