(বাঁ দিকে) অর্পিতা মুখোপাধ্যায় , পার্থ চট্টোপাধ্যায় (ডান দিকে)
‘অ-পা’ জুটির প্রথম জন অর্পিতা মুখোপাধ্যায় সবে জামিন পেয়েছেন। দ্বিতীয় জন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের তরফে এ বার কার্যত অর্পিতার সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করা হল। সুপ্রিম কোর্টে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জামিনের আবেদনের মামলায় আজ তাঁর আইনজীবী মুকুল রোহতগি দাবি করলেন, অর্পিতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা, গয়নার সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কোনও সম্পর্ক নেই। অর্পিতা এক জন অভিনেত্রী। তাঁর সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বয়ানের ভিত্তিতে পার্থকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উল্টো দিকে পার্থের জামিনে আপত্তি তুলে ইডি-র আইনজীবী কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল এস ভি রাজু দাবি করেছেন, অর্পিতা মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে তিনি পার্থকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। তা ছাড়া পার্থ জামিন পেলে তথ্যপ্রমাণ লোপাট হতে পারে। যা শুনে পার্থের আইনজীবী রোহতগি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা অর্পিতাকে নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন।
কলকাতায় সিবিআই-ইডির বিশেষ আদালত, কলকাতা হাই কোর্টে জামিন না পেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। জামিনের দাবিতে পার্থের আইনজীবীদের প্রধান যুক্তি ছিল, ২০২২-এর ২৩ জুলাই পার্থকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার পরে প্রায় আড়াই বছর কেটে গিয়েছে। এখনও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। চারটি অতিরিক্ত চার্জশিট দায়ের হয়েছে। পার্থের বয়স ৭৩ বছর। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তাতে সর্বোচ্চ সাত বছর জেল হয়। পার্থ ইতিমধ্যেই তার তিন ভাগের এক ভাগের বেশি সময় জেলে কাটিয়ে ফেলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্য কান্ত ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়ার বেঞ্চ আজ প্রশ্ন তুলেছে, কত দিন পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জেলে আটক করে রাখা সম্ভব? বিচারপতি সূর্য কান্ত প্রশ্ন তুলেছেন, নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় এখনও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এই মামলায় ১৮৩ জন সাক্ষী রয়েছে। বিচারে সময় লাগবে। কত দিন পর্যন্ত আটকে রাখা যায়?
ইডি-র দোষী সাব্যস্ত করার হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়া জানতে চেয়েছেন, যদি শেষ পর্যন্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায় দোষী সাব্যস্ত না হন, তা হলে কী হবে? আড়াই থেকে তিন বছর কম সময় নয়। ইডি-র দোষী সাব্যস্ত করার হার কি? যদি তা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হত, তা-ও বোঝা যেত। কিন্তু এই হার খুবই খারাপ।
বিচারপতি সূর্য কান্ত অবশ্য মেনে নিয়েছেন, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ যথেষ্ট গুরুতর। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সব মামলাই অসৎ উদ্দেশ্যে করা, তা বলা যায় না। কারণ রাজনীতিকদের পক্ষে প্রথমে দুর্নীতি করে পরে নিজেদের সৎ দাবি করা খুবই সহজ। ইডি-র আইনজীবী বলেন, এ ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হবেন।
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতার বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের নগদ, গয়না উদ্ধার হয়েছিল। পার্থ ও অর্পিতার শান্তিনিকেতনে ‘অপা’ নামের বাড়ির খোঁজ মিলেছিল। আজ পার্থের হয়ে তাঁর আইনজীবী মুকুল রোহতগি, অনির্বাণ গুহঠাকুরতারা যুক্তি দিয়েছেন, নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় সবাই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। যে মহিলার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছিল, যাঁর বয়ানের ভিত্তিতে পার্থকে গ্রেফতার করা হয়, সেই অর্পিতা দু’দিন আগে জামিন পেয়ে গিয়েছেন। পার্থের বাড়ি থেকে কোনও টাকা উদ্ধার হয়নি। অর্পিতার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছে। তিনি পার্থের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। নিয়োগ দুর্নীতির আর দুই অভিযুক্ত, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মাণিক ভট্টাচার্য ও তাঁর ছেলে সৌভিকও জামিন পেয়ে গিয়েছেন। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ৪৭৯ ধারায় বলা হয়েছে, সাজার সর্বোচ্চ মেয়াদের অর্ধেক সময়ের বেশি অভিযুক্তকে জেলে আটকে রাখা যাবে না। যদি অভিযুক্তের আগের অপরাধের রেকর্ড না থাকে, তা হলে সাজার তিন ভাগের এক ভাগ সময় জেলে কাটিয়ে ফেললেই জামিন মিলবে। তবে মূল অপরাধে সিবিআইয়ের মামলা থাকলে জামিন মিলবে না বলে ইডি যুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তা হলে ইডি-র কোনও মামলাতেই কেউ জামিন পাবে না। এখানে সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
ইডি-র আইনজীবী রাজু বলেন, অর্পিতা জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া টাকা পার্থের। ব্যাপক পরিমাণে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। ৫০ হাজার চাকরিপ্রার্থী চাকরির জন্য অপেক্ষা করছেন। চারটি ভিন্ন পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে। চারটি সিবিআইয়ের মামলায় চারটি এফআইআর দায়ের হয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে ৪৭৯ ধারায় জামিনের শর্ত খাটবে না। এ ক্ষেত্রে অন্তত সাড়ে তিন বছর আটক করে রাখা যেতে পারে। ইডি-র মামলায় জামিন পেলেও পার্থ ছাড়া পাবেন না। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের মামলা রয়েছে। রাজু যুক্তি দেন, ‘‘পার্থ জামিন পেলে তাঁর নাম করে অর্পিতা যে বয়ান দিয়েছেন, তা থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। অর্পিতা বলেছেন, তিনি পার্থকে ভয় পাচ্ছেন।’’ পার্থের প্রভাবের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, তিনি ডাক্তারদের উপরে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। গ্রেফতার হওয়ার পরে হাসপাতালে তাঁর অসুস্থতা নিয়ে ভুল রিপোর্ট তৈরি করানো হয়েছিল। রোহতগি বলেন, উনি আর মন্ত্রী নন।
বিচারপতি সূর্য কান্ত বলেন, জামিন মঞ্জুর না করলে কী হবে? বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লাগবে। কী ভাবে এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়? এটাও অস্বীকার করা যায় না যে অভিযোগ গুরুতর। রোহতগি বলেন, ইডি-র মামলায় জামিনের আবেদনের পরে পার্থকে জেলে সিবিআই গ্রেফতার করেছে। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল ২০২২-এর জুনে। এ সব অসৎ উদ্দেশ্যে করা মামলা বলে রোহতগি অভিযোগ তোলেন। বিচারপতি সূর্য কান্ত বলেন, সব মামলা অসৎ উদ্দেশ্যে করা নয়।
বিচারপতিরা আজ পার্থ, ইডি, সিবিআইয়ের কাছে জানতে চান, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইডি, সিবিআইয়ের হেফাজতে কত দিন ছিলেন, কত দিন জেলে ছিলেন? পার্থকে এই নিয়ে সিবিআই দ্বিতীয় বার গ্রেফতার করেছে, না কি তাঁকে আগেও সিবিআই গ্রেফতার করে হেফাজতে নিয়েছিল? সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, এই মামলার ফের সোমবার শুনানি হবে।
অন্য দিকে, আজ কলকাতা হাই কোর্টে পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ পাঁচ জনের জামিন মামলার দ্রুত শুনানির আবেদন জানিয়ে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁদের আইনজীবীরা। বিচারপতি এই মামলার সাথে যুক্ত সব পক্ষকে নোটিস দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।