রেললাইনে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে রয়েছে ট্রেনের কামরা। তার তলায় চাপা পড়ে রয়েছে যাত্রীদের রক্তাক্ত দেহ। নিজস্ব চিত্র।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুপুর সওয়া ৩টে নাগাদ হাওড়ার অদূরে শালিমার স্টেশন থেকে ছেড়েছিল আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। প্রায় চার ঘণ্টা পরে ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ২৩ কামরার ট্রেনটি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃশ্যবদল। রেললাইনে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে রয়েছে ট্রেনের কামরা। তার তলায় চাপা পড়ে রয়েছে যাত্রীদের রক্তাক্ত দেহ। মালপত্রও ছড়িয়ে রয়েছে এ দিক-ও দিক। এ যেন এক বিভীষিকা। শুধুমাত্র আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস নয়, আরও দু’টি ট্রেন বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছে ধাক্কা লেগে লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনা কী করে ঘটেছে, তার একাধিক বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। রেলের বয়ান অনুযায়ী, দু’টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একটি মালগাড়িও।
স্থানীয় একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, প্রথমে করমণ্ডল এক্সপ্রেস তীব্র গতিতে গিয়ে ধাক্কা মারে একই লাইনে আগে চলতে থাকা একটি মালগাড়ির পিছনে। দুর্ঘটনার অভিঘাতে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি ওই মালগাড়ির উপরে উঠে যায়। ২৩টি কামরার মধ্যে ১৫টি কামরা লাইন থেকে ছিটকে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে। ঠিক সেই মুহূর্তে ওই লাইন দিয়ে আসছিল ডাউন বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। ডাউন লাইনে পড়ে থাকা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত কামরাগুলির উপর এসে পড়ে বেঙ্গালুরু-হাওড়া ডাউন ট্রেনটি। সঙ্গে সঙ্গে হাওড়াগামী সেই ট্রেনটির দু’টি কামরাও লাইনচ্যুত হয়।
শুক্রবার রাত থেকেই বালেশ্বরে ভয়াবহ পরিস্থিতি। যাত্রীদের উদ্ধার করতে রাতভর চলেছে উদ্ধারকাজ। উদ্ধারকর্মী থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও যাত্রীদের প্রাণরক্ষা করতে উদ্যত হয়ে রয়েছেন। রাতের অন্ধকার উপেক্ষা করে উদ্ধারকাজ চলছে শনিবার সকাল পর্যন্ত। কিন্তু সারা রাত ধরে কী ভাবে চলেছে উদ্ধারকাজ?
স্থানীয় সূত্রের খবর, শুক্রবার সন্ধ্যায় রেল দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোবাইল হেলথ ইউনিটের গাড়ি। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ২০০টি অ্যাম্বুল্যান্স, ৫০টি বাস এবং ৪৫টি মোবাইল হেলথ ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর আধিকারিক থেকে শুরু করে দমকলকর্মীরা হাত লাগিয়েছেন উদ্ধারকাজে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, লাইনচ্যুত কামরার তলা থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করতে গ্যাসকাটার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারাও। আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে কখনও তাঁদের জলের তেষ্টা মেটাচ্ছেন, কখনও বা রেললাইনের আশপাশে ছড়িয়ে থাকা মালপত্র জোগাড় করে এক জায়গায় জড়ো করছেন।
শুক্রবার দুর্ঘটনার পর সতর্ক করা হয়েছে রাজ্যের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলিকেও। ভুবনেশ্বর এমস-ও যেন প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পারে, নেওয়া হয়েছে তার ব্যবস্থাও। হাসপাতালে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে আহত যাত্রীদের সংখ্যা। ওয়ার্ডের পাশাপাশি হাসপাতালের করিডরেও স্ট্রেচারে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আহতেরা। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে নিহত এবং আহত যাত্রীদের সংখ্যা বাঁধ মানছে না। রেল সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২৬১। আহতের সংখ্যা ৬৫০-এরও বেশি বলে রেলের দাবি।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা থেকে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছেন ঘটনাস্থলে। অসমর্থিত সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে মমতা ঘটনাস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শনিবার সকালে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে তিনি হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেবেন। ফিরে আসবেন শনিবারেই। শুক্রবার রাতে হাওড়া এবং শালিমার স্টেশনে ভিড় করেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রীদের উদ্বিগ্ন পরিজনেরা। দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারবর্গকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকা, গুরুতর আহতদের ২ লক্ষ টাকা এবং অল্প আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রত্যক্ষদর্শীদের আশঙ্কা, উদ্ধারকাজ যত এগোবে, নিহত এবং আহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে এখনও বহু যাত্রী আটকে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।