গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষা বলছে, লোকসভা নির্বাচনের ছ’মাসের মাথায় মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা ভোটে আবার জিততে পারে বিজেপির জোট। কিন্তু ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে এমন পূর্বাভাস যে অতীতে বার বার ভুল প্রমাণিত হয়েছে, সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে কংগ্রেস-সহ ‘ইন্ডিয়া’-র সহযোগীরা। শাসক এবং বিরোধী শিবিরের এই টানাপড়েনের মধ্যেই শনিবার সকাল ৮টা থেকে ঝাড়খণ্ড এবং মহারাষ্ট্রে ভোটগণনা শুরু হচ্ছে।
এর পাশাপাশি গণনা হবে পশ্চিমবঙ্গের ছ’টি বিধানসভা-সহ (কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া ও নৈহাটি, বাঁকুড়ার তালড্যাংরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর) মোট ১৫টি রাজ্যের ৪৮টি বিধানসভা এবং দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের। মহারাষ্ট্রের নান্দেড় লোকসভার পাশাপাশি সেই তালিকায় রয়েছে কেরলের ওয়েনাড়। যেখানে কংগ্রেসের প্রার্থী প্রিয়ঙ্কা বঢরা গান্ধী। বাংলার পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের ন’টি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলও থাকবে রাজনৈতিক মহলের নজরে। দুপুরের মধ্যে ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে। বাংলার পড়শি রাজ্যে মোট ৮১টি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে ভোট হয়েছিল প্রথম দফায়, গত ১৩ নভেম্বর। বাকি ৩৮টিতে দ্বিতীয় দফায়, ২০ নভেম্বর। মহারাষ্ট্রের ২৮৮ আসনেই ২০ নভেম্বর এক দফায় ভোট হয়েছিল।
মহারাষ্ট্র:
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্যে (জনসংখ্যার নিরিখে) মূল লড়াই বিজেপি-শিবসেনা (একনাথ শিন্ডে)-এনসিপি (অজিত)-এর জোট ‘মহাজুটি’এবং কংগ্রেস-শিবসেনা (ইউবিটি)-এনসিপি (শরদ)-এর ‘মহাবিকাশ আঘাড়ী’র মধ্যে। সমাজবাদী পার্টি, সিপিএম এবং সিপিআইকে কয়েকটি আসন ছেড়েছে আঘাড়ী। এ ছাড়া ভোটের ময়দানে রয়েছে রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস), বাবাসাহেব অম্বেডকরের পুত্র তথা প্রাক্তন সাংসদ প্রকাশ অম্বেডকরের ‘বঞ্চিত বহুজন আঘাড়ী’ (ভিবিএ), হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসির ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-সহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দল। কয়েকটি বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস মেনে বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হলে (অর্থাৎ, ২৮৮ আসনের মধ্যে কোনও জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ১৪৫ ছুঁতে না পারলে) সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এই ‘ছোট’ দলগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ‘মহাজুটি’র গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা শিবসেনা প্রধান একনাথ শিন্ডে (কোপরি-পাচপাখাড়ি), দুই উপমুখ্যমন্ত্রী, এনসিপির অজিত পওয়ার (বারামতী) এবং বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস (নাগপুর দক্ষিণ-পশ্চিম)। বিরোধী জোটের উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের পুত্র আদিত্য (ওরলি), প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নানা পাটোলে (সাকোলি), বিরোধী দলনেতা বিজয় ওয়াদ্দেতিয়ার (ব্রহ্মপুরী) প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ (কারাড দক্ষিণ) এবং শরদ পওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপি(এসপি)-র পরিষদীয় দলনেতা জিতেন্দ্র আওয়াড় (মুমব্রা-কালওয়া) ও প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী জয়ন্ত পাটিল (ইসলামপুর)।
প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় নিরুপম এবং মিলিন্দ দেওরা দল বদলে এ বার মুম্বইয়ের দিন্দোসী ও ওরলি কেন্দ্রে শিন্ডেসেনার প্রার্থী। মাহিমে এমএনএস প্রধান রাজ ঠাকরের পুত্র অমিত লড়ছেন। এনসিপি মুম্বইয়ের বান্দ্রা পূর্ব আসনে নিহত বিধায়ক বাবা সিদ্দিকির পুত্র জিশানকে টিকিট দিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দীর্ঘ দিন ধরে খয়রাতির রাজনীতির সমালোচনা করলেও মধ্যপ্রদেশের পরে এ বার মহারাষ্ট্রেও সেই পথে হেঁটেছে তার দল। বিজেপির ‘সঙ্কল্প পত্র’ বলছে, এনডিএ সরকার ক্ষমতায় এলে লাডলি বহিন যোজনায় মহিলারা মাসিক পনেরোশো টাকার পরিবর্তে একুশশো টাকা করে, অর্থাৎ বছরে ২৫ হাজার টাকা পাবেন।
পাল্টা বিরোধী শিবির মহিলাদের তিন হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সরকারের বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি নীতির সমালোচনায় বিজেপি সরব হলেও মহারাষ্ট্রে কিন্তু কেজরীওয়ালের পথে হেঁটে বিদ্যুৎ বিলে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণা করেছে দল। এ ছাড়া কৃষকদের ভোট পেতে কৃষক সম্মান নিধি যোজনায় ১২ হাজার টাকার পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে অন্তত কুড়ি শতাংশ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছে, যা মহারাষ্ট্রের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে বিজেপিকে সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
২০১৯-এর বিধানসভা ভোটে অবিভক্ত শিবসেনা এবং বিজেপির জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে উদ্ধবের সঙ্গে বিজেপির মতবিরোধ তৈরি হয়। এর পরে তৎকালীন অবিভক্ত এনসিপির প্রধান শরদ পওয়ারের ভাইপো অজিত ‘বিদ্রোহী’ হয়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান। তাঁর সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস। অজিত হন উপমুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এনসিপি পরিষদীয় দলে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হয়ে ইস্তফা দিতে হয় তাঁদের দু’জনকে। এর পর অজিত আবার শরদের শিবিরে আশ্রয় নেন। তাঁকে শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন মহাবিকাশ আঘাড়ী জোট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন শরদ।
কিন্তু ২০২২-এর জুন মাসে একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বে শিবসেনায় ভাঙন ধরলে মহাবিকাশ আঘাড়ী সরকারের পতন ঘটে। বিজেপির সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হন শিন্ডে। এর পর ২০২৩ সালের ২ জুলাই শরদের সঙ্গ ছেড়ে অধিকাংশ এনসিপি বিধায়ককে নিয়ে বিদ্রোহী হয়েছিলেন অজিত। শিন্ডের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজুটি’ সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রীও হন। কিন্তু লোকসভা ভোটে ‘ইন্ডিয়া’র কাছে এনডিএর ভরাড়ুবি পরে অজিতের সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বে মতবিরোধ একাধিক বার প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে ভোটের পর ‘নতুন সমীকরণের’ সম্ভবনারও ইঙ্গিত রয়েছে মরাঠাভূমিতে।
ঝাড়খণ্ড:
৮১ সদস্যের ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ৪১টি আসন। ২০১৯-এর বিধানসভা ভোটে প্রায় সাড়ে ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিল জেএনএম-কংগ্রেস-আরজেডির ‘মহাগঠবন্ধন’। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জেএমএম প্রতিষ্ঠাতা শিবু সোরেনের পুত্র হেমন্ত। এ বারও তিন দল একসঙ্গে লড়ছে। সঙ্গে পেয়েছে বাম দল সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে।
ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে মূল লড়াই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএর। গত বার আলাদা লড়লেও বিজেপি এ বার প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুদেশ মাহাতোর ‘অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ (আজসু)-এর সঙ্গে জোট গড়েছে। সঙ্গে রয়েছে বিহারের নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ানের দল এলজেপি (রামবিলাস)। বিজেপি ৬৮, আজসু ১০, জেডিইউ দু’টি এবং এলজেপিআর একটি আসনে লড়ছে। অন্য দিকে, ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরে জেএমএম ৪৩, কংগ্রেস ৩০, আরজেডি ৭ এবং সিপিআইএমএল (লিবারেশন) ৪টি আসনে লড়ছে। চলতি বছরই কুড়মি-মাহাতো জনগোষ্ঠীর নেতা জয়রাম মাহাতোর তৈরি দল ‘ঝাড়খণ্ড লোকতান্ত্রিক ক্রান্তিকারী মোর্চা’ (জেএলকেএম) ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে চমক দেখাতে পারে বলে কয়েকটি বুথফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত।
গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন (বরহেট), তাঁর স্ত্রী কল্পনা (গাঁডেয়), ভাই বসন্ত (দুমকা)। বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন দলের রাজ্য সভাপতি বাবুলাল মরান্ডি (ধনওয়ার) এবং প্রাক্তন জেএমএম বিধায়ক তথা হেমন্তের বৌদি সীতা (জামতাড়া), প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলত্যাগী জেএমএম নেতা চম্পই সোরেন (সেরাইকেলা), তাঁর পুত্র বাবুলাল (ঘাটশিলা), দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী— মধু কোড়ার স্ত্রী তথা প্রাক্তন সাংসদ গীতা কোড়া (জগনাথপুর) এবং অর্জুন মুন্ডার স্ত্রী মীরা (পোটকা)। বিজেপির আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের পুত্রবধূ পূর্ণিমা লড়ছেন জামশেদপুর (পূর্ব) আসনে।
উল্লেখযোগ্য কংগ্রেস প্রার্থী, এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক তথা প্রাক্তন আইপিএস অজয় কুমার (জামশেদপুর পূর্ব) এবং মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের মন্ত্রিসভার সদস্য তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামেশ্বর ওরাওঁ (লোহারডাগা)। এ বারে বিধানসভা ভোটের প্রচারে মোদী, অমিত শাহ-সহ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা জেএমএম-কংগ্রেস-আরজেডির ‘মহাগঠবন্ধন’ বিরুদ্ধে জমি কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির পাশাপাশি ‘জমি জিহাদে’ মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ধারাবাহিক ভাবে। তাঁদের অভিযোগ, পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠী ঝাড়খণ্ডে অনুপ্রবেশ করে ধীরে ধীরে জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে।