অশোক গহলৌত। ছবি: পিটিআই।
পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সরকারে দু’জনেই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এক জন ছিলেন ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ, শিশু ও নারী কল্যাণ মন্ত্রকে। অন্য জন ছিলেন বস্ত্র মন্ত্রকে। এখন দু’জনেই মুখ্যমন্ত্রী।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী। যার পুনরাবৃত্তি তিনি করেছেন ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও। ঠিক সেই পথে হেঁটে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত বলছেন, রাজ্যের ২০০টি বিধানসভা কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী।
আবার ষোলোর মতো একুশের বিধানসভা ভোটেও মমতা বলেছিলেন, ‘‘এই ভোটটা আমার ভোট। প্রার্থী কারা হল, তা দেখার দরকার নেই।’’ আর এখন রাজস্থান বিধানসভার ভোটে গহলৌত বলছেন, ‘‘আমি সবাইকে আর্জি জানাচ্ছি, ২০০ আসনে আমিই ভোটে লড়ছি। স্থানীয় স্তরে কে কোথায় প্রার্থী হয়েছে, তা দেখার দরকার নেই।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চ্যালেঞ্জ ছিল, তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ। সেই সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ। গহলৌতের সামনে একই চ্যালেঞ্জ। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেও নিয়োগ দুর্নীতি, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ। মমতা তাঁর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিজের ভাবমূর্তিকে বাজি ধরেছিলেন। অশোক গহলৌতও নিজেকেই বাজি ধরছেন।
মমতার হাতিয়ার ছিল, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কন্যাশ্রীর মতো জনমুখী প্রকল্প। গহলৌতের হাতিয়ার, তাঁর চিরঞ্জীবী স্বাস্থ্য বিমা যোজনা থেকে মহিলাদের মোবাইল, স্বাস্থ্যের অধিকার আইন থেকে শহরে রোজগার নিশ্চয়তা আইন। বিধানসভা নির্বাচনের সাত গ্যারান্টিতে গোবর থেকে ল্যাপটপ কিছুই বাদ নেই। সঙ্গে রয়েছে তাঁর ওবিসি মালি সম্প্রদায়ের পরিচিতি।
রাজস্থানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলে যাওয়া গত তিন দশকের ইতিহাস। আপনি কি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে তিন দশকের ইতিহাস বদলে দিতে নিজেকে বাজি ধরলেন? দিনভর প্রচরের ব্যস্ততার মধ্যে এই প্রশ্ন শুনে স্বভাবরসিক অশোক গহলৌত মুচকি হেসে বলেন, ‘‘আসলে আমার জমানায় এত রকম আইন পাশ হয়েছে, এত জনমুখী প্রকল্প হয়েছে, ইতিমধ্যেই আমরা ১০টি গ্যারান্টি দিয়েছি, ভবিষ্যতের জন্য আরও সাতটি গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে, যে তার ফলে একটা আবহ তৈরি হয়েছে। মানুষ স্বাগত জানাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়েছে।’’ বারবার মনে করাচ্ছেন, ক্ষমতায় ফিরলে তিনি মহিলাদের বছরে ১০ হাজার টাকা ভাতা, ৫০০ টাকায় সিলিন্ডার, ২ টাকা কেজি দরে গোবর কেনা, পুরনো পেনশন প্রকল্প, কলেজ পড়ুয়াদের ল্যাপটপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিমা, ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল শিক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
পাঁচ বছর আগে বিজেপির বসুন্ধরা রাজে সরকারকে সরিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। সে বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনেক চেষ্টা করেছিলেন, নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির সরকার বাঁচাতে। লাভ হয়নি। রাজস্থানের অলিগলিতে স্লোগান উঠেছিল, ‘মোদী তুঝসে বৈর নহি, বসু্ন্ধরা তেরি খৈর নহি।’ অর্থাৎ, মোদীকে নিয়ে সমস্যা নেই। তা বলে বসুন্ধরা ছাড় পাবেন না। এ বার রাজস্থানের অলিতে গলিতে স্লোগান উঠেছে, ‘গহলৌত তুঝসে বৈর নহি, বিধায়ককা খৈর নহি।’ অর্থাৎ, গহলৌতকে নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু কংগ্রেসের বিধায়কদের বিরুদ্ধে ভোটের বাক্সে ক্ষোভ জমা পড়বে। গহলৌত তাই নিজেই দু’শো আসনে নিজেকে প্রার্থী করে দিয়েছেন। বাহাত্তর বছর বয়সে গোটা রাজ্যে প্রচার করছেন।
পাঁচ বছর আগে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরানোর পিছনে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সচিন পাইলটের বিরাট ভূমিকা ছিল। গহলৌতের সঙ্গে রেষারেষিতে পাইলট কোণঠাসা। উপরে উপরে বিবাদ মিটলেও পাইলট নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। ফলে সব দায় গহলৌতের উপরেই। দিন শুরু হচ্ছে সকাল সাতটায়। সকাল ন’টা থেকে বাড়িতে লোকজন ভিড় করছে। দিন শেষ হচ্ছে রাত দুটোয়। দিনে চার থেকে পাঁচটা জনসভা। দিনে অন্তত ৮০০ কিলোমিটার যাতায়াত। গহলৌত বলেন, ‘‘দু’শো আসনে আমাদের প্রার্থী লড়ছে। দেড়শো কেন্দ্রে প্রচারে যেতে হবে। তার থেকেও বেশি আসনে জেতা আমাদের লক্ষ্য। সব জায়গায় যেতে পারছি না। তাই মানুষকে বলছি, ধরে নিন আমিই দু’শো আসনে প্রার্থী। জনতাই তো মা-বাপ।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অশোক গহলৌতের অবশ্য আরও একটা মিল রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখনও প্রধান ‘ইউএসপি’ তাঁর সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা। যার প্রতীক তাঁর কালিঘাটের বাড়ি। অশোক গহলৌতেরও ‘ইউএসপি’ হল যোধপুরের সর্দারপুরার ঘিঞ্জি গলিতে তাঁর পরিবারের দোতলা বাড়ি। তাঁর বাবা লক্ষ্মণ সিংহ গহলৌত ছিলেন জাদুকর। গোটা রাজ্যে জাদু দেখিয়ে বেড়াতেন। ছেলে বাবার থেকে জাদুর কারসাজি শিখেছিলেন ঠিকই। তবে সেই জাদুবিদ্যা দেখানোর জন্য রাজনীতিকে বেছে নিয়েছেন।
সর্দারপুরার বাড়িতে এখন শুধু অশোকের দিদি বিমলা থাকেন। ১৯৯৮ থেকে সর্দারপুরার বিধায়ক, তার আগে যোধপুরের সাংসদ, তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী হলেও যোধপুরে নিজের আলাদা বাড়ি করেননি গহলৌত। পুরনো বাড়িই তাঁর ঠিকানা হিসেবে থেকে গিয়েছে। উল্টে ওই বাড়ির সামনের রাস্তা মহা মন্দির লেন লোকমুখে ‘সিএম গলি’ হয়ে গিয়েছে।
জয়পুরে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে অশোক গহলৌতের এক ঘনিষ্ঠ অনুগামী বলেন, মুখ্যমন্ত্রী এ বার নিজের বিধানসভা কেন্দ্রেও প্রচারে যাওয়ার সময় পাননি। সর্দারপুরার কংগ্রেস নেতাদের বলে দিয়েছেন, উনি যেতে পারবেন না। সর্দারপুরা জেতানোর দায়িত্ব তাঁদের কাঁধেই।
তাতে অসুবিধা হতে পারে? উত্তর মেলে, ‘‘উনি শুধু জয়পুরের জাদুকর নন। সর্দারপুরার সর্দারও।’’