মস্তিষ্কের কোন কোন অংশে কেমন অনুভূতি জাগে? প্রতীকী ছবি।
মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই জটিল। রহস্যময়। তার কোথায় কী ঘটছে, তা জানাই বড় কঠিন কাজ। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ন’হাজার কোটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন রয়েছে। প্রতিটা নিউরন আবার হাজার হাজার নিউরনের সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে তথ্য আদানপ্রদান করে যেগুলি ভাবা, শেখা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, কথা বলা, কাজকর্ম করা, চলাফেরা সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। আবার প্রেম-ভালবাসার অনুভূতির জন্যও তারা দায়ী। এই যে কাউকে দেখে হঠাৎ ভাল লাগল অথবা প্রেম-প্রেম ভাব হল, তার জন্য মস্তিষ্কের আলাদা কুঠুরি আছে। সেখান থেকেই প্রেমের আবেগকে চালনা করা হয়। আবার প্রেম তো শুধু এক রকম নয়, তারও নানা প্রকার আছে। মা-বাবার প্রতি ভালবাসা, সন্তান প্রেম, পোষ্যের প্রতি প্রেম, অপরিচিত কারও প্রতি আবেগ বা শ্রদ্ধা, প্রকৃতিকে ভালবাসা ইত্যাদি যত রকমের ভালবাসার অনুভূতি আছে, সবের জন্যই কিন্তু আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে মস্তিষ্কে। আর সেই ঘরগুলিরই নকশা এঁকেছেন বিজ্ঞানীরা।
মানুষের মস্তিষ্কের যে এই বৈচিত্র, তা নিয়ে গবেষণা অনেক হয়েছে। বিশ্ব জুড়েই গবেষণা চলছে। তার মধ্যে ফিনল্যান্ডের আলটো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ও তাদের কার্যকলাপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণার মূল অংশ ছিল, মানব মস্তিষ্কের ঠিক কোথায় কোথায় প্রেম, ভালবাসা বা আবেগের অনুভূতি তৈরি হয়। এই গবেষণার ফল অক্সফোর্ডের একটি বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সেরিব্রাল কর্টেক্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা ৫৫ জনকে নিয়ে একটি পরীক্ষা করেছিলেন। তাঁদের মস্তিষ্কের ‘এফএমআরআই’ (ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজ়োন্যান্স ইমেজিং) করে দেখা হয়, ঠিক কোথায় কোথায় প্রেম-ভালবাসার উদ্দীপনা জাগে। সেই মতো তাঁরা মস্তিষ্কের মানচিত্রও তৈরি করেন। তাতে অবাক করা কিছু তথ্য ধরা পড়ে।
সহজ করে বললে মানুষের আনন্দ, দুঃখ, রাগ, ভালবাসা— যে কোনও অনুভূতির সঙ্গেই কিন্তু বিজ্ঞান জড়িয়ে। এই যে রাগ হয়, সেটি চালনা করে মস্তিষ্কের ‘অ্যামিগডালা’ অংশ। আবার দুঃখ, হতাশা, মনে রাখা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি এইগুলি চালনার জন্য রয়েছে মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সের ‘লিম্বিক লোব’-এর মধ্যে হিপোক্যাম্পাস অংশ। এই অংশে গোলযোগ হলেই তখন অটিজ়ম, স্কিৎজোফ্রিনিয়া, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিনাশের মতো অসুখ হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তেমনই একটি জায়গা হল ‘টেম্পোরোপ্যারিটাল ফাংশন’, যেটি আবেগ, অনুভূতি, দৃষ্টি, শ্রবণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সঙ্গীর প্রতি প্রেম, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়- পরিজনের প্রতি ভালবাসা এই অংশ থেকেই চালিত হয়। কারও প্রেমে পড়লে ওই অংশে উদ্দীপনা তৈরি হয়, আবার কারও প্রতি স্নেহ-শ্রদ্ধা জাগলেও ওই অংশটিই সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আবার যখন পোষ্যের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয় তখন মস্তিষ্কের ‘অরবিটোফ্রন্টাল কর্টেক্স ’ অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই অংশটি চোখের ঠিক পিছনে থাকে। যখনই এই অংশ সক্রিয় হয়, তখনই পোষ্যের প্রতি আলাদা আবেগ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা নিউরোইমেজিং করে দেখেছেন, কাউকে দেখে সুন্দর লাগা, তার প্রতি আকর্ষণ জন্মানো অথবা একটি শিশুকে দেখে বা কোলে নিয়ে তাকে স্পর্শ করে স্নেহের অনুভূতি জাগাও মস্তিষ্কের ওই অংশই নিয়ন্ত্রণ করে।
সুখের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে মস্তিষ্কের একটি অঞ্চল কাজ করে যার নাম ‘প্রিকিউনিয়াস’। সুখ ও সন্তুষ্টি এই দুই অনুভূতিকে চালনা করে মস্তিষ্কের ওই অংশ। প্রেম বা ভালবাসার উপলব্ধি, সুখের অনুভূতি হয় ওই অংশ থেকেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, যে মানুষের মস্তিষ্কের ওই অংশটি বেশি উদ্দীপিত, তাঁরা জীবনকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন।
এ তো গেল ব্যক্তি বা প্রাণীর প্রতি ভালবাসা অথবা আবেগের কথা। প্রকৃতির প্রতি যে প্রেম, তার জন্য আবার মস্তিষ্কের আলাদা আলাদা অংশ রয়েছে। মূলত ‘প্যারাহিপ্পোক্যাম্পাল জ়াইরাস’, ‘সুপিরিয়র প্যারাইটাল লোব’ ও তার আশপাশের কিছু অংশ সক্রিয় হলে প্রকৃতি বা পরিবেশের প্রতি প্রেম তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, মস্তিষ্কের কী কী অংশ কোন কোন আবেগ বা অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা সম্পূর্ণ ভাবে জানা গেলে তবেই বিভিন্ন মানসিক বা স্নায়বিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে। মস্তিষ্কের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাও সহজ হবে।