জলবায়ু বদলের জেরে মনের কী কী অসুখবিসুখ দেখা দিচ্ছে? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
উষ্ণতা বাড়ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান। আন্টার্কটিকায় হিমবাহে ভাঙন ধরেছে। জলবায়ু বদলের ভয়ঙ্কর প্রভাব খাঁড়া ঝুলিয়েই রেখেছে। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার মতিগতি। আর এর জের শুধু পারিপার্শ্বিক পরিবেশে নয়, মানুষের মন ও মস্তিষ্কেও সমান ভাবে পড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভেক্টরবাহিত রোগ বাড়ছে। পাশাপাশি নানারকম মানসিক অসুখবিসুখ জাঁকিয়ে বসছে। জলবায়ু বদলের ফলে কী কী প্রভাব পড়ছে শরীর ও মনে?
১. অপুষ্টিজনিত রোগের শিকার শিশুরা
জলবায়ু বদলের প্রভাবে কোথাও নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, কোথাও খরায় মাটি ফুটিফাটা। পরিবেশবিদদের পূর্বাভাস, আগামী কয়েক বছরে জলবায়ু বদলের ভয়ঙ্কর প্রভাব টের পাবে ভারত। তাঁদের দাবি, জলবায়ু চরিত্র যে ভাবে বদলাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে পাহাড়প্রমাণ ঢেউ আছড়ে পড়বে, তৈরি হবে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। তছনছ হবে উপকূলবর্তী এলাকা, ধ্বংস হবে অরণ্য। ফলে ফসলের ফলনও কমবে। বিশ্ব জুড়েই তীব্র হবে খাদ্য সঙ্কট। যার কারণে অনাহার ও অপুষ্টির শিকার হবে শিশুরা। রিপোর্ট বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার বাড়বে আরও ২০ শতাংশ।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা বলছে, পাঁচ বছরের নীচে ২০ শতাংশ শিশু অনাহার ও অপুষ্টির শিকার। ‘দ্য স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন, ২০১৯’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৩৭ জন শিশুর মৃত্যু হয় অপুষ্টি-সহ নানা কারণে। দেশের মাত্র ২১ শতাংশ শিশুর খাদ্যতালিকায় বিবিধ এবং সুষম আহারের যথাযথ সমন্বয় মেলে। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ শিশু থেকে যায় এর বাইরে। পুষ্টির অভাবে অধিকাংশ শিশুই নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাইপার টেনশন, সুগার, কিডনির অসুখ জাঁকিয়ে বসছে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে।
২. বাড়ছে পরজীবী-বাহিত রোগ
বিশ্ব উষ্ণায়ণে তাপমাত্রা বাড়ছে পৃথিবীর। আর সেই সঙ্গেই বাড়ছে ভেক্টর-বাহিত রোগ। সাম্প্রতিক তথ্যে উঠে এসেছে, জলবায়ু বদলের বড় প্রভাব পড়ছে পরজীবীদের উপর। ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশাও রূপ বদলে ফেলছে। জিনের গঠনবিন্যাসের এমন পরিবর্তন ঘটাচ্ছে অ্যানোফিলিস মশা যে কীটনাশকেও রোখা সম্ভব হচ্ছে না। আর এই সবই হচ্ছে জলবায়ু বদলের কারণে।
বিজ্ঞানীর আশঙ্কা, পৃথিবীর তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই ম্যালেরিয়া মশার প্রকোপ বাড়বে। যে কোনও দুর্ভেদ্য প্রতিরোধেও ফাঁক খুঁজে জিতে যাচ্ছে মশারাই। এর কারণই হল পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে । উষ্ণায়ণের ভেলকিতে মশারা তাদের বেঁচেবর্তে থাকার উপায় খুঁজে নিচ্ছে।
৩. মানসিক অসুখবিসুখ মাথাচাড়া দিচ্ছে
গরম আর তাপপ্রবাহ যত বাড়বে, ততই স্নায়ুজনিত অসুখও বাড়বে, এমনটাই মত গবেষক, পরিবেশবিদদের। বর্তমান সময়ের নানা গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা যত বাড়বে, আবহাওয়ায় তত বেশি বদল আসবে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে অ্যালঝাইমার্স, স্মৃতিনাশ বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগ, স্নায়ুর নানা অসুখ। তার উপর বায়ুদূষণ তো রয়েছেই। বাতাসে ভাসমান বিষাক্ত কণাও স্নায়ুর উপর প্রভাব ফেলছে। তা ছাড়া প্লাস্টিকজনিত দূষণ তো রয়েছেই। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর রাসায়নিক হরমোনের ভারসাম্য বিগড়ে দিচ্ছে। জটিল প্রভাব ফেলছে মন ও মস্তিষ্কে।
৪. অসংক্রমণজনিত রোগও চিন্তার কারণ
গবেষকরা দাবি করছেন, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বায়ু দূষণজনিত সংক্রমণ ও জটিল অসুখের কারণে হার্টের রোগে ভুগছেন। ধূমপান না করলেও হৃদ্রোগের আশঙ্কা বাড়ছে। বাতাসে এখন বিষাক্ত গ্যাস ও অ্যারোসলের মাত্রা তার থেকে অনেক বেশি। কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, বেনজিন, সালফার ডাই অক্সাইড, ওজোন ও আরও কয়েকটি বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শে এলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঝুঁকি বাড়ে। বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ বাড়লে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের গতি বেড়ে যায়। রক্তবাহী ধমনীতে চর্বি জমে এই রোগ হয়। দূষণ এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া বাতাসে ভাসমান বিষাক্ত কণা শরীরে ঢুকতে থাকলে হার্টরেট বেড়ে যেতে পারে, ছন্দ হারাতে পারে হৃদয়।
৫. বাড়ছে অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতাও
রিপোর্ট বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অবসাদ, মানসিক চাপ বাড়ছে। সেই থেকে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। দেখা গিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি মানুষ অতিরিক্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাজনিত নানা রোগে ভুগছেন। জলবায়ু বদলের প্রভাব যত বাড়বে, ততই এই ধরনের রোগ আরও বেশি বাড়বে বলেই অনুমান গবেষকদের।