ঋতুস্রাবের সময়ে কী ব্যবহার করেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অনলাইনে স্যানিটারি প্যাড কিনতে গিয়ে ‘মেনস্ট্রুয়াল কাপ’ জিনিসটি চোখে পড়েছে অনেক দিন আগেই। কিন্তু কেনার সাহস দেখাতে পারেননি সুমনা। বাইরে থেকে শরীরের অভ্যন্তরে কিছু প্রবেশ করানো নিয়ে তাঁর অদ্ভুত ভয় কাজ করে। ঠিক সে কারণেই কোনও দিন ট্যাম্পন ব্যবহার করারও ইচ্ছা হয়নি তাঁর। এ দিকে, স্যানিটারি প্যাডের দু’ধারের ‘উইংগস্’ থেকে প্রায় সময়েই কুঁচকিতে র্যাশ হয়। তা হলে কি আবার সেই পুরনো পন্থা অর্থাৎ, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতির কাপড়ে ফিরে যাওয়াই নিরাপদ? কী বলছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা?
পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ‘ক্যাফেটেরিয়া অ্যাপ্রোচ’ বলে একটি কথা খুব প্রচলিত। কফির তো বিভিন্ন ধরন রয়েছে। ক্যাফেতে গিয়ে মেনু দেখে যেমন কফির ধরন পছন্দ করে নেওয়া যায়, তেমনই নানা ধরনের জন্ম নিরোধক বাজারে রয়েছে। তার মধ্যে কার কোনটি পছন্দ বা কে কোনটিতে স্বচ্ছন্দ, তা বুঝে ব্যবহার করা যায়। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ওই একই ‘অ্যাপ্রোচ’ কিন্তু ‘মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন’ বা ঋতুস্রাব চলাকালীন পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও প্রযোজ্য। মল্লিনাথ বলেন, “ঋতুস্রাব চলাকালীন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে বাজারে নানা ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। সব ক’টিই নিরাপদ। কিন্তু কার জন্য কোনটি ভাল, তা নিজেকেই বুঝতে হবে।”
আলমারিতে পোশাকের তলায় কিংবা ব্যাগের গুপ্ত কুঠুরিতে স্যানিটারি প্যাড রাখার অভ্যাস নেই। কারণ, বছর দুয়েক হল ঋতুস্রাবের সময়ে রিমা মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করছেন। প্রথম প্রথম একটু ভয়, দ্বিধা ছিল। তবে ইউটিউবে এই সংক্রান্ত নানা রকম ভিডিয়ো দেখার পর সেই জড়তা কেটে গিয়েছে। পোশাকে দাগ লেগে যাওয়ার ভয় নেই। মিটিং, মিছিল কিংবা পরীক্ষা চলাকালীন প্যাড বদলানোর চিন্তাও নেই। শরীরের ভিতরে যে কিছু একটা রয়েছে, তা বোঝাই যায় না কাপ বা ট্যাম্পন ব্যবহার করলে। প্যাড বা ট্যাম্পন কিন্তু পরিবেশবান্ধব নয়। সে দিক থেকে মেনস্ট্রুয়াল কাপ অনেক দিক থেকেই নিরাপদ। তা ছাড়া, এই জিনিসটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তাই সহকর্মীরা বিপদে পড়ে প্যাড চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের কথা বলেন।
উন্নত দেশগুলিতে তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও মেনস্ট্রুয়াল কাপ কিংবা ট্যাম্পন ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুম্বই, দিল্লি, পুণে, বেঙ্গালুরু কিংবা হায়দরাবাদের মতো শহরে এই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল এক যুগ আগেই। ভয়, সংশয়, উদ্বেগ কাটিয়ে দেরিতে হলেও এ শহরের মেয়েরা প্যাডের বিকল্প হিসাবে মেনস্ট্রুয়াল কাপ বা ট্যাম্পন ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে।
প্রতিটি জিনিসেরই তো আলাদা আলাদা সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। ঋতুস্রাব হলে মহিলারা সাধারণত স্যানিটারি প্যাডই ব্যবহার করেন। সুতির কাপড়ের চেয়ে তা ঢের ভাল। কিন্তু সমস্যা হল এই ধরনের প্যাডে রাসায়নিকের ব্যবহার। দীর্ঘ দিন ধরে এক ভাবে তা ব্যবহার করে গেলে শারীরিক সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মঞ্জরী চট্টোপাধ্যায় বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কমবয়সি মেয়েদের যৌনাঙ্গে সংক্রমণের নেপথ্যে রয়েছে এই স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পন। কারণ, এই জিনিসগুলি ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। কোনওটিই দীর্ঘ ক্ষণ শরীরের সংস্পর্শে রাখা যায় না। প্যাড যদিও শরীরে বাইরে থাকে। কিন্তু ট্যাম্পন যোনিদ্বার দিয়ে প্রবেশ করাতে হয়। মঞ্জরী বলেন, “অনেকেই ট্যাম্পন পরে তা বার করতে ভুলে যান। দীর্ঘ ক্ষণ তা যোনিপথে আটকে থাকলে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। ট্যাম্পন থেকে প্রাণঘাতী ‘টক্সিক শক সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।” অতিরিক্ত রক্তপাত সামাল দেওয়ার জন্য পিরিয়ড প্যান্টির জনপ্রিয়তাও ইদানীং বেড়েছে। যা দেখতে অনেকটা ডায়াপারের মতো। ‘হেভি ফ্লো’-এর সমস্যায় কিংবা দীর্ঘ ক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতে হলে এই পিরিয়ড প্যান্টি কিন্তু বেশ কাজের। আবার, সঠিক পদ্ধতি জানা থাকলে মেনস্ট্রুয়াল কাপ নিয়েও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্যাড বা ট্যাম্পন সহজে মাটিতে মেশে না। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মেনস্ট্রুয়াল কাপের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই। এবং সাশ্রয়ীও।
আগেকার দিনে ঠাকুমা-দিদিমারা ঋতুস্রাব হলে পরিষ্কার সুতির কাপড় ব্যবহার করতেন। এখনও প্রত্যন্ত গ্রামে, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মহিলারা কাপড়ই ব্যবহার করেন। অনলাইন বিভিন্ন সাইটে ঢুঁ মারলে দেখা যাবে সেই পুরনো আমলের সুতির কাপড়ই আবার ফিরে আসছে নতুন মোড়কে। সুতির কাপড়ে রাসায়নিকের ব্যবহার নেই। কিন্তু তা কি আদৌ স্বাস্থ্যকর? মল্লিনাথ বলেন, “প্যাড ছেড়ে আগের মতো সুতির কাপড় ব্যবহার করলেও কোনও সমস্যা নেই। শুধু ব্যবহারের পদ্ধতি, সুবিধা-অসুবিধা এবং পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।”
তবে ঋতুস্রাবজনিত সংক্রমণের দায়ভার শুধু স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন কিংবা মেনস্ট্রুয়াল কাপের নয়। কে কতটা পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে তা ব্যবহার করছেন, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে। চিকিৎসকেরা বলছেন, কাপড়ের বদলে সিলিকনের তৈরি মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে যে সংক্রমণ হবে না, যেমন নয়। তবে তার ভয়বহতা কম। আবার, পরিষ্কার সুতির কাপড়ের তৈরি প্যাড ত্বকের জন্য ভাল। কিন্তু দীর্ঘ ক্ষণ পরে থাকলে কিংবা সঠিক ভাবে পরিষ্কার না করলে সেই সুতির কাপড়ই ব্যাক্টেরিয়ার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারে। তবে এই ধরনের সমস্যা এড়াতে হলে ‘মেনার্কি’ বা প্রথম ঋতুস্রাব শুরুর সময় থেকেই পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। ঋতুস্রাব, ঋতুস্রাবজনিত সংক্রমণ এবং ঋতু চলাকালীন ব্যবহারের জিনিসগুলি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।