এক ফ্রেমে প্রদীপ ভট্টাচার্য, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: উইন্ডোজ় প্রযোজনা সংস্থা।
ভাইপো যদি ‘শের’, খুড়ো ‘সওয়া শের’! বলছে টলিউড। উইন্ডোজ় প্রযোজনা সংস্থার পুজোর ছবি ‘বহুরূপী’তে অনেকটা জুড়ে তিনি। ৫৫ বছর অভিনয়ের পর ফোনে প্রশংসার বন্যা। রাস্তাঘাটে নিজস্বী তোলার বায়না। বহরমপুরের প্রদীপ ভট্টাচার্য রাতারাতি ‘তারকা’?
প্রশ্ন: ‘বহুরূপী’ দেখে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় জড়িয়ে ধরে আদর করছেন!
প্রদীপ: (অল্প হেসে) ‘বহুরূপী’তে অভিনয় দেখে সবাই ভাল বলছেন। সকলে ভালবাসছেন। এটা হচ্ছে।
প্রশ্ন: সকলে এ-ও বলছেন, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমাত্র টক্কর আপনিই দিয়েছেন...
প্রদীপ: (একটু ভেবে) এর উত্তর কী দিই? আমি কিন্তু বিষয়টি ও ভাবে দেখছি না। আমার মঞ্চাভিনয়ের বয়স ৫৫, পর্দার ৪৫। কম বয়সে ‘বাঞ্ছা এল ফিরে’ নামে একটি ছবি করেছিলাম। ভাল চলেছিল, প্রশংসাও পেয়েছিলাম। তাই ‘টক্কর’টা আমার কাছে বিষয় নয়। ‘টক্কর’ ব্যাপারটাও মানি না। আমার কাছে যে চরিত্র আসে, আমি তাকে উপভোগ করি। সেটা ‘বেলাশেষে’ হতে পারে, কিংবা ‘বেলাশুরু’। একটা ছবি পরিচালকের ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন। অভিনেতা সেটা বাস্তবায়িত করেন। মন দিয়ে কাজ করার মতো বিষয় তাই প্রাধান্য পায়।
প্রশ্ন: ‘টক্কর’ শব্দটিকে সরিয়ে যদি বলি, শিবপ্রসাদ আর আপনি সমানে সমানে পাল্লা দিয়েছেন?
প্রদীপ: তা হলে বলব, এটাই আমার কাজ। থিয়েটারের প্রশিক্ষণ শিখিয়েছে, সামনে যিনিই থাকুন, আমি আমার কাজ করে যাব। এ প্রসঙ্গে ছোট মুখে একটা বড় কথা বলছি। কোনও দিন বিপরীতে অমিতাভ বচ্চন থাকলেও আমার কিচ্ছু যাবে-আসবে না। কারণ, তিনিও অভিনেতা, আর আমিও ছোট মাপের হলেও অভিনেতাই। সেই জায়গা থেকে আমার যা দেওয়ার, সেটাই দেব। কোনও দিন এই বিষয়ে ফাঁকি দিইনি। এই ছবিতেও সেটাই করেছি। চরিত্রটি উপভোগ করেছি। অভিনয়ের অনেকটা সুযোগ পেয়েছি। এই ইতিবাচক দিকটিকে যত্নের সঙ্গে পর্দায় ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। তুলনা করলে খুব মুশকিলে পড়ে যাই। (একটু থেমে) তবে অনেকেরই আমাকে ভাল লেগেছে। ছবিটি ব্লকবাস্টার, তাই হয়তো সকলের একটু বেশিই নজরে পড়ছি।
প্রশ্ন: আপনাকে নিয়ে টলিউড তা হলে নতুন করে ভাবছে?
প্রদীপ: ভাবছে, অনেক ডাকও পাচ্ছি।
প্রশ্ন: হালফিলের ধারা, বর্ষীয়ান অভিনেতারা শিরোনামে। যেমন, পরান বন্দ্যোপাধ্যায় বা আপনি। আপনারা প্রমাণ করছেন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে...
প্রদীপ: প্রমাণ করছি না, প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। আমরা কিন্তু কোনও দিনই খারাপ অভিনয় করিনি। ইন্ডাস্ট্রির দেখার চোখ বদলেছে। মাঝে বাংলা বাণিজ্যিক ছবি মানেই সুদর্শন নায়ক, দক্ষিণী ছবির মতো মারপিট, কিছু জনপ্রিয় গান মিলিয়ে প্যাকেজ তৈরি হত। বাংলা ছবিতে গল্প বলার ধরন বদলে গিয়েছিল। ওগুলোকে ‘বাংলা ছবি’ বলা যায় না। হালে পুরনো ধারা, গল্প বলার তাগিদ একটু হলেও ফিরছে। এবং আমার চোখে, ‘সো কল্ড’ নায়ক নেই। এই ছবিতেই দেখুন, শিবুর উচ্চতা আর আমার উচ্চতা প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু, শিবু কী অবলীলায় সকলকে টপকে গিয়েছে! ‘ইচ্ছে’ থেকে চেষ্টা করতে করতে ও আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা ছবির চেনা ঘরানাকেই আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো শিবুর ছবি সত্যজিৎ রায়ের মাপের নয়। কিন্তু, তরুণ মজুমদার বা তপন সিংহের গল্প বলার মজাটা পুরো মাত্রায় আছে। চরিত্রগুলো সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি, তাদের গায়ে মাটির গন্ধ রয়েছে বলেই দর্শকও রিলেট করতে পারছেন।
প্রশ্ন: তা হলে আবার ‘বই’ দেখার যুগ ফিরছে?
প্রদীপ: অবশ্যই। পাশাপাশি, এই ছবিতে বাণিজ্যিক উপাদনও যথেষ্ট। তাই রাজ্যে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমে গেলেও ‘বহুরূপী’ রমরমিয়ে চলছে।
প্রশ্ন: এই ছবির দৌলতে অনেকটা সময় পর্দা জুড়ে থাকলেন, বড় চরিত্রে অভিনয় করলেন— সম্ভবত অনেক দেরিতে এই সুযোগ পেলেন...
প্রদীপ: আক্ষেপ করি না। আক্ষেপে বিশ্বাস নেই। ৯৫টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছি। প্রত্যেকটা খুব কাছের এবং গুরুত্বপূর্ণ। ছোট পর্দা ছেড়েছি ২০ বছর আগে। যে ক’টা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছি, প্রত্যেকটা হিট। মনখারাপ করি না। মনখারাপ করলে, আক্ষেপ করলে নতুন চরিত্র, নতুন কাজ পাব না।
প্রশ্ন: ‘বহুরূপী’তে এমন কোনও দৃশ্য আছে, যেখানে আপনি শিবপ্রসাদকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েননি?
প্রদীপ: একটি দৃশ্যে আমি শুয়ে, শিবু আমার কাছে এসে ডাকাতি করার পরিকল্পনা জানাচ্ছে। ওই একটি দৃশ্যে শিবুকে জায়গা ছাড়িনি। (শ্বাস নিয়ে) আমার আর শিবুর বোঝাপড়া বরাবর ভাল। ওই দৃশ্যটা করার পর ও আমায় জড়িয়ে ধরেছিল। দেখি, ওর চোখ দুটো চিকচিক করছে!
প্রশ্ন: অর্থাৎ, বাস্তবেও পর্দার মতোই প্রদীপ-শিবপ্রসাদ ‘খুড়ো-ভাইপো’?
প্রদীপ: একদমই তাই। শিবু তো আমার ভাইপোর বয়সিই। আমরা দু’জনেই থিয়েটারের মানুষ। বরং ওরাই আমায় নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগে। শট শেষে এসি ভ্যানে বসি না। বনবন করে এ দিক-সে দিক ঘুরে বেড়াই। দলের বাকিরা খুঁজতে খুঁজতে নির্ঘাত ভাবে, বুড়োটা গেল কোথায়?
প্রশ্ন: পর্দার বাইরে প্রদীপ ভট্টাচার্য কেমন?
প্রদীপ: (হেসে ফেলে) পর্দায় যেমন দেখছেন। বাস্তবেও আমি ও রকমই ভাঙা সাইকেলে ঘুরি। বাইক, চারচাকা চড়ি না।
প্রশ্ন: মানে, পর্দার মতোই ‘তরমুজ খাব’ বলে দৌড়োন?
প্রদীপ: ওটা তো ইম্প্রোভাইজ় করা! ছবিতে ও রকম অনেক টুকরো দৃশ্য আছে যেটা আমি নিজে থেকে যোগ করেছি। ডাকাতি করে আনন্দও হয়েছে, তেষ্টাও পেয়েছে। তাই খুড়ো তরমুজ খেতে দৌড়েছে— ওই বাড়তি অংশ দৃশ্যটিকে আরও নাটকীয় করেছে। নইলে আমার তো কথা ছিল, ডাকাতি করে বেরিয়ে মোটরবাইকে চেপে চলে যাব। তরমুজ খাওয়ার কথাই ছিল না। আমার সেটা খুব সাদামাঠা মনে হয়েছিল। ওটুকু যোগ করে দিলাম। এ রকম অনেক কিছু যোগ করার পর দেখছি দর্শক দৃশ্যগুলো দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।
প্রশ্ন: সাধারণ মানুষ এখন চিনতে পেরে ঘিরে ধরছেন?
প্রদীপ: আগেও হত। এই ছবির পর আগের তুলনায় সে সব বেড়েছে। কথা বলছেন, নিজস্বী তুলছেন। আমায় নিয়ে কত জন বাজি ধরেন, ধুর! উনি আসল প্রদীপ ভট্টাচার্যই নন। খুব উপভোগ করি। এগুলো ভাল লাগে বলেই সাধারণ ট্রেনে যাতায়াত করি। আমার প্রশিক্ষণও হয়ে যায়। এগুলোই আমার অভিনয়ের ক্লাস বলতে পারেন।
প্রশ্ন: ছবি নিয়ে, আপনার অভিনয় নিয়ে শুধুই প্রশংসা? কোনও সমালোচনা শোনেননি?
প্রদীপ: আমার কিছু দর্শকবন্ধুর সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁদের মত, কিছু দৃশ্য বা গান না থাকলে ছবি আরও টান টান হত। এ-ও জানিয়েছেন, ‘বহুরূপী’ শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে রূপক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেই রূপক আরও যত্ন নিয়ে দেখালে এই ছবিটি হয়তো জাতীয় পুরস্কারের দাবিদার হতে পারত। আবার তাঁরাই বলেছেন, সেই খামতি পূরণ করে দিয়েছে ছবির শেষ ভাগ। তাঁদের চোখে শেষের ২০ মিনিট নাকি টি-২০ ম্যাচ!
প্রশ্ন: ‘রক্তবীজ’ না ‘বহুরূপী’— কাকে এগিয়ে রাখবেন?
প্রদীপ: (একটুও না ভেবে) প্রথম ছবিটি দ্বিতীয় ছবির জমি তৈরি করে দিয়েছিল। আগের ছবিটি করতে করতে দ্বিতীয় ছবিটি তৈরির পথ তৈরি হয়েছে। দুটোই তাই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: আগামী দিনে প্রদীপ ভট্টাচার্যকে আর কোন কোন ভূমিকায় দেখা যাবে?
প্রদীপ: জানি না, বলতে পারব না। ডাক পাচ্ছি নানা জায়গা থেকে। কিন্তু কথায় আছে, ‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই’। সকলের মতো আমারও ইচ্ছে, ছাপ রেখে যাব। বলিউডে কাজ করার বাসনাও রয়েছে কাউকে ধরাকরা না করে। দেখি, কতটা কী করতে পারি।