‘পাশবালিশ’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে সুহোত্র ও ইশা। ছবি: সংগৃহীত।
‘…কই গেলা রে বন্ধু/ কই গেল রে/ আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু/ কই গেলা রে’…
বাংলার সীমান্তবর্তী চা-বাগান এলাকার সবুজঘেরা গ্রাম, আকুল এক কিশোর মন আর বার বার ফিরে আসা এই সুর, আকুল করে ‘পাশবালিশ’-এর দর্শককে। পর্ব থেকে পর্বান্তরে যায় সিরিজ় আর বার বার ঘুরেফিরে আসে এই নিরুদ্দেশের ব্যাকুল প্রশ্ন, কই গেলা রে বন্ধু, কই রইলা রে?
কোরক মুর্মুর পরিচালনায় এই সিরিজ় দেখা যাচ্ছে, জ়ি অরিজিনালস-এ। আসলে এই গল্প দুই কিশোর-কিশোরীর। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা অনাথ দুই কিশোর-কিশোরীর গভীর বন্ধুত্ব এগিয়ে নিয়ে যায় সিরিজ়। তার পর এক সময় ছিটকে যায় হাত, নিকষ অন্ধকারে হারিয়ে যায় প্রাণের বন্ধু। তবু কোনও ভাবেই নিপাট রোম্যান্টিক ছবির চার দেওয়ালে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না ‘পাশবালিশ’কে। বরং এর ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে রহস্য-রোমাঞ্চের ঘনঘটা।
এক কথায় অভিজিৎ মল্লিক এবং অর্কদীপ মল্লিকা নাথের টান টান চিত্রনাট্য ‘পাশবালিশ’-কে করে তুলেছে মনোরঞ্জক। রীতিমতো বাণিজ্যিক ফর্মুলায় তৈরি এই গল্প ছোট থেকে বড় হয়ে যাওয়া দুই বন্ধুর। মাম্পি ওরফে আঁচল মল্লিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইশা সাহা এবং তাঁর ছোটবেলার বন্ধু বাবলা ওরফে চাঁদুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুহোত্র মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু বাল্যপ্রেমে নাকি অভিশাপ থাকে! সেই অভিশাপ বুকে নিয়ে চাঁদু বড় হতে থাকে বাংলার এক মফস্সল শহর পাথরকুচির থানায়। সেখানেই ফরমাশ খাটে সে। নিতান্ত নিরীহ হলেও চাঁদুর চরিত্রটি মজাদার। তার উপর সে আবার ভাল গান গায়। তার গলাতেই ফিরে ফিরে আসে সেই ধ্রুবপদ, ‘কই গেলা রে বন্ধু/কই গেলা রে’।
চাঁদু খুঁজে বেড়ায় ছোটবেলার সঙ্গী মাম্পিকে। অথচ, সেই মাম্পিই এখন সাংবাদিক আঁচল, থাকে পাথরকুচি টাউনশিপের এক বিত্তশালী পরিবারে, চাঁদুর খুব কাছে। সেই পরিবারেই বড় হয়েছে সে। আঁচলকে একদিন চিনে ফেলে চাঁদু। কিন্তু আঁচল পারে না, তবু গড়ে ওঠে এক অদ্ভুত সম্পর্ক।
সীমান্তবর্তী চা-বাগান অঞ্চলের নিসর্গ এ ছবির অন্যতম জোরের দিক, সে কথা বলাই যায়। কিন্তু সেই সুন্দর সবুজের মধ্যেই থাবা বসায় হিংসা। বোমা-বারুদ, মাদক চক্র— সব মিলিয়ে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে।
আসলে এই হিংসার মূলে রয়েছে টাউনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী পাহাড়বংশী গ্রামের আদিবাসীদের সংঘাত। অতীতের কোনও হত্যাকাণ্ড তৈরি করে উপজাতিদের তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা। আর তার পিছনে রয়েছেন মহাদেব মল্লিক, টাউনের যুদ্ধবাজ স্বঘোষিত এক নেতা। তাঁর সঙ্গে আবার আঁচলের গভীর সম্পর্ক।
রোম্যান্টিক থ্রিলার ‘পাশবালিশ’ বেশ আঁটসাঁট, বসিয়ে রাখবে দর্শককে। যদিও শেষ দিকে গল্পের কোনও কোনও অংশ অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। অকারণে দীর্ঘ, শিথিল বলেও মনে হতে পারে। অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়, চাঁদুর ভুমিকায় সুহোত্রের অভিনয়ের। চাঁদুর চোখের ভাষায় কখনও সারল্য, কখনও অপ্রতিরোধ্য উন্মাদনা। আবার মাম্পির প্রতি তাঁর চূড়ান্ত অধিকারবোধ সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেতা। আঁচল চরিত্রে একই সঙ্গে দৃঢ়তা ও অসহায়তা চমৎকার ফুটিয়েছেন ঈশা। পাহাড়বংশী উপজাতি অধিনেতা হিসাবে সৌরভ দাসের অভিনয় আরও উজ্জীবিত হতে পারত। কোনও কোনও জায়গায় তাঁর অভিনয় বেশ চমক জাগায়। পুলিশ আধিকারিকের ভূমিকায় ঋষি কৌশিকের কমেডি মেশানো তুখোড় অভিনয় যেমন নজর কাড়ে, তেমনই মহাদেব মল্লিকের চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথের ‘না অভিনয়ের অভিনয়’ একটি আলাদা মাত্রা দিয়েছে সিরিজ়টিকে। যদিও কোনও কোনও জায়গায় অতিনাটকীয়তাও রয়েছে বলে মনে হয়।
সাতটি পর্বের ‘পাশবালিশ’-এ প্রায় প্রত্যেকটি পর্বের প্রথমে বড় মনোরম ভাবে এসেছে চাঁদু আর আঁচলের কৈশোরকালের মন্তাজ। আদ্যন্ত বাণিজ্যিক ফর্মুলায় তৈরি হলেও মাঝেমাঝে দৃশ্যবিন্যাসের কারুকাজ ব্যতিক্রমী তো বটেই! রে রে করে ছুটে আসা সংঘাতের অ্যাকশন দৃশ্য বা বুক দুরুদুরু করা বিশ্বাসযোগ্যতায় ভরপুর।
আর অবশ্যই এর আবহের কথা বলতেই হয়। শচীন দেববর্মণের গাওয়া ‘রঙ্গিলা রে’ গানটিকে নতুন ভাবে সৃজন করেছেন মৃন্ময় সান্যাল।