(বাঁ দিক থেকে) লগ্নজিতা চক্রবর্তী, রূপঙ্কর বাগচী, শোভন গঙ্গোপাধ্যায়, সিধু, অনুপম রায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
ইতিহাস বলছে দেশ, কাল নির্বিশেষে বিভিন্ন গণ আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে গান, বার বার। ভারতের মাটিতে ভক্তি আন্দোলনে গানের একটা বড় ভূমিকা ছিল। সন্ত কবীর থেকে শ্রীচৈতন্য— গানই হয়ে উঠেছে অস্ত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দেমাতরম’ ছিল বীজমন্ত্র। কখনও আন্দোলনের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রইল বলে রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে’। ১৯৪৬-এ প্রতিবাদ সমাবেশে সুচিত্রা মিত্রের দৃপ্ত কণ্ঠে ‘সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এ দেশে’ গানটি ইতিহাসে খচিত রয়েছে। আবার কখনও হেমাঙ্গ বিশ্বাস বা সলিল চৌধুরীর গান আগুনের মতো জ্বলেছে বিপ্লবে বিক্ষোভে।
এই মুহূর্তে আরজি কর-কাণ্ডের জেরে উত্তাল গোটা বাংলা। পথে নেমেছিলেন বাংলার সঙ্গীতশিল্পীরাও। কখনও স্লোগান তুলে, কখনও বা গান গেয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তার মধ্যেই সমাজমাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ‘আরজি কর’-এর মতো ঘটনায় কি গান গেয়ে প্রতিবাদ করা যায়? এই সময় কি আদৌ গলা বেয়ে গান ওঠে?
এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনকে রূপঙ্কর বাগচী বলেন, “অবশ্যই গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ হয়। বব ডিলান থেকে শুরু করে এমন বহু শিল্পী রয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। আমাদের এখানে কবীর সুমন, নচিকেতা, শিলাজিৎ মজুমদারও করেছেন।” এই আবহে ‘ক্ষমা কর’ নামে একটি গান মুক্তি পেয়েছে গায়কেরও। তবে এই গানকে প্রতিবাদের গান বলতে চান না রূপঙ্কর। তাঁর কথায়, “এই গান প্রতিবাদের নয়। এই গান এক অসহায় বাবার গান। আসলে ১৪ অগস্ট রাতে আমার অনুষ্ঠান ছিল। আমি সেই সময়ে ফিরছিলাম। রাস্তায় প্রতিবাদী মানুষের ঢল সেই সময়। বাচ্চাকে কোলে নিয়েও বাবা-মায়ের রাস্তায় নেমেছিলেন। এ সব দেখে মনে হচ্ছিল, আরজি করের চিকিৎসকের জায়গায় তো আমার মেয়েও হতে পারত। আমার কান্না পাচ্ছিল। মেয়েটা চলে গেল এটাই যন্ত্রণা দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, মেয়েটা যেন আমারই। এই ভাবনা থেকেই এই গান।”
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে একাধিক মিছিলে হাঁটতে দেখা গিয়েছে লগ্নজিতা চক্রবর্তীকে। গায়িকা বলেন, “আমি বেশ কিছু মিছিলে হেঁটেছি। কিছু কিছু মিছিলে স্লোগান দিয়েছি। সঙ্গীতশিল্পীদের মিছিলে গান গেয়েছি। কিছু কিছু মিছিলে চুপ করে থেকেছি। আমি সেন্ট জ়েভিয়ার্সের ছাত্রী। তাই ছাত্র আন্দোলন করিনি কোনও দিন। তবে রাজনীতি নিয়ে বরাবরই আমি সচেতন। এই প্রথম আমি কোনও আন্দোলন নেমেছি।”
লগ্নজিতা মনে করেন প্রত্যেকে নিজের মতো করে প্রতিবাদ করতে পারেন। তাঁর কথায়, “এই আন্দোলন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু একটা বিষয় দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি, কে কী ভাবে প্রতিবাদ করবে সেটাও নাকি অন্যেরা ঠিক করে দিচ্ছেন! আমরা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি, অথচ সেখানে অন্য একটা ব্যবস্থার আওতায় থাকতে হবে, এটা খুবই অদ্ভুত। সকলকে বলতে চাই, যে ভাবে ইচ্ছে প্রতিবাদ করুন। গান গেয়ে বিপ্লব আসবে না কি স্লোগান তুলে বিপ্লব আসবে, সেটা আলোচনা করার মতো অবস্থা এখন নেই। শ্রীকান্তদা (শ্রীকান্ত আচার্য) এর মধ্যে একটা অনুষ্ঠান করেছেন কালো ব্যাজ পরে। এটাও তো প্রতিবাদ। আমার বাপের বাড়ির পাড়ার এক বন্ধু এখন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। আমাদের সঙ্গীতশিল্পীদের মিছিল নিয়ে ও আমাকে খুব অপমান করেছে। আমি এদের বলতে চাই, কোনও মিছিলকে অপমান করার আগে একটু ভেবেচিন্তেই করা উচিত।”
গানের মাধ্যমে আরজি করের নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে ব্যান্ড ক্যাকটাসও। প্রতিবাদের ভাষা, কলম থেকে নিয়ে গান যে কোনও মাধ্যমই হতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। সিধু বলেছেন, “প্রতিবাদ মানেই শুধুই মিছিল বা সমাবেশ নয়। চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। আবার একজন লেখক লেখার মাধ্যমে নিজের মতামত স্পষ্ট করতে পারেন। আমরা সঙ্গীতশিল্পী। আমরা তো আমাদের ভাষাতেই প্রতিবাদ জানাব। আমরা তাতেই সবচেয়ে বেশি সক্ষম। এটাই আমাদের অস্ত্র। মিছিলে যোগদান করার প্রস্তাব অহরহ আসছে। কিন্তু আমার ভাষা তো গান। তাই আমরা একটি গান করেছি এবং যার পিছনে আমরা সকলে বহু পরিশ্রম করেছি।”
কিছুটা ভিন্ন মত শোভন গঙ্গোপাধ্যায়ের। বিভিন্ন মিছিলে হেঁটেছেন এবং নিয়মিত মিছিল সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় সমাজমাধ্যমে ভাগ করে নিচ্ছেন তিনি। গায়ক বলেন, “এক জন সরকারি কর্মী বা কর্পোরেট সংস্থার কর্মীকে যে কোনও পরিস্থিতিতেই নিজের কাজটা করতে হয় দায়িত্বের সঙ্গে। আমাদের কাজ গান গাওয়া। এটাই আমাদের পেশা। কিন্তু এই আন্দোলনের সঙ্গে আমি ভীষণ ভাবে জড়িত। তাই গান গাওয়ার জন্য এখন যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি প্রয়োজন পড়ে, তা আমার মধ্যে নেই। কোনও গান গাইতে গেলেই আরজি করের ঘটনা মাথায় চলে আসছে। যা যা শুনছি, দেখছি, ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউরে উঠছি। করোনা অতিমারীর সময়ে মানুষ ঘরে বসে গান গাইছিলেন, সেটা অন্য বিষয়। গান অবশ্যই প্রতিবাদের ভাষা। কিন্তু ছোটবেলা থেকে যে ভাবে গলা তুলে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছি, সেই ভাবেই এখন প্রতিবাদ করতে হবে। নিজের প্রয়োজনে এখন গান গাইতে পারছি না।”
অনুপম রায় যদিও মনে করেন, প্রতিবাদের ভাষা আসলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তাঁর কথায়, “বহু প্রতিবাদী গান তৈরি হয়। যাঁর গান গাইতে ইচ্ছে করবে তিনি গাইবেন। যাঁর গান গাইতে ইচ্ছে করবেন না তিনি গাইবেন না। এতে ঠিক বা ভুলের কোনও জায়গা নেই।”