শুভ গুহঠাকুরতা
বিশ্বভারতী এবং ব্রাহ্ম সমাজের বাইরে এনে রবীন্দ্রনাথের গানকে কলকাতা শহরের সাংস্কৃতিক প্রবহমানতায় যুক্ত করেছিলেন যে মানুষটি তাঁর নাম শুভ গুহঠাকুরতা। শুক্রবার ছিল তাঁর ১০৩ বছরের জন্মদিন।
প্রচারবিমুখ কর্মদ্যোগী এই ব্যক্তিত্বের জন্ম কোনও সাঙ্গীতিক পরিবারে হয়নি। তবু কম বয়স থেকেই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় তিনি ব্রাহ্ম পরিবারের দুই সন্তান বিথীন্দ্র নাথ গুপ্ত এবং দিলীপ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসেন। দক্ষিণীর কর্ণধার সুদেব গুহঠাকুরতার কথায়, "বাবার সেই দুই বন্ধু প্রথম আবিষ্কার করেন, রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি ওঁর বিশেষ আগ্রহ। ওঁরাই তাঁকে রবিবার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনায় আমন্ত্রণ জানান।"
শুভ গুহঠাকুরতা সানন্দে রাজি হয়ে যান। এর পর থেকে প্রতি রবিবার তিনি সমাজের উপাসনায় পৌঁছে যেতেন গানের টানে। তাঁর এই আগ্রহ ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর জ্যাঠতুতো বোন পরিচালক-অভিনেত্রী অরুন্ধতী দেবীকেও। সুদেব জানান, অরুন্ধতী দেবীই শুভ গুহ ঠাকুরতাকে প্রথম নিয়ে যান শান্তিনিকেতন। আলাপ করিয়ে দেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে।
এর পর থেকে শুভ গুহঠাকুরতা নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন শান্তিনিকেতনে। সেখানেই তাঁর আলাপ হয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কমলা বসুর সঙ্গে। সুদেব বললেন, "এঁরা তিন জন মিলে শৈলজদার কাছে গান শিখতেন। আর সেই গান শেখার ফাঁকেই শুভ গুহ ঠাকুরতার কানে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং আফসোস করে বলেছিলেন, তাঁর গান সীমাবদ্ধ রইল রাঙামাটির দেশে। তার বাইরে সেই গানের প্রচার, প্রসার কিছুই হল না। শৈলজদা তখন নিজে বাবাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গান প্রচারের জন্য উদ্যোগ নিতে।"
১৯১৮ সালের ১০ জুলাই বরিশালের বানারিপাড়া গ্রামে গুহঠাকুরতা পরিবারে জন্মেছিলেন শুভ গুহঠাকুরতা। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের অষ্টম সন্তান তিনি। মাত্র ছ’মাস বয়সে পিতৃহারা হন। ছ’বছর বয়সে দাদা-দিদিদের হাত ধরে সপরিবারে বানারিপাড়া ছেড়ে চলে আসেন কলকাতার পাইকপাড়ায়। টাউন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেই সময় তাঁর অভিভাবক ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী ঋতু গুহ-র বাবা নির্মল চন্দ্র গুহ ঠাকুরতা এবং তাঁর সেজদি পঙ্কজ বালা বসু।সেই শুভ গুহঠাকুরতাকে দায়িত্ব দেওয়া হল কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচারের জন্য!
১৯৪১ সাল। ২২ শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আশ্রম শূন্য। শুভ গুহঠাকুরতা যোগাযোগ করলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর সঙ্গে। পুত্র সুদেবের স্মৃতি উজ্জ্বল। তিনি বললেন, "তাঁদের আশীর্বাদ নিয়ে পরের বছরের ডিসেম্বরে বাবা প্রতিষ্ঠা করেন গীতবিতান সঙ্গীত শিক্ষায়তন। এটাই বাবার রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়ে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।"
কিন্তু তখন সে গান শিখতে চাইতেন ক’জন?
আকাশবাণীর শিল্পী তালিকার পাতা ওল্টালেই দেখা যাবে তখন পুরুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মাত্র ৮ জন। সুদেব বলছেন, "গীতবিতানের পরে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বাবা ১৯৪৮ সালের ২৫ বৈশাখ প্রতিষ্ঠা করেন দক্ষিণী সঙ্গীত শিক্ষায়তন। যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া অন্য কোনও গানের চর্চা হবে না, এমনই নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবা। মাত্র ১২ জন শিক্ষার্থী দিয়ে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। পরে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় হাজারেরও বেশি।"
শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ নয়। রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করতে শুভ গুহঠাকুরতা আকাশবাণীর মাধ্যমে ত্রৈবার্ষিক রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। শান্তিনিকেতন সহ-রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে ১০০ জন রবীন্দ্র গানের শিল্পীদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াতে আরম্ভ করেন তিনি। এ ভাবেই ধীরে ধীরে সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান।
শুভ গুহঠাকুরতার পরবর্তী পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সহজ ভাষায় বোধগম্য করা। এর জন্য তিনি একটি বই লিখলেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষার্থীদের ‘সঙ্গীত চিন্তা’ বা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবনী’ পড়তে বলা হত। সুদেব বললেন, "শিক্ষার্থীদের কাছে ওই বই গুলো ততটাও আকর্ষণীয় ছিল না। বাবা রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানের আলাদা বিচার করে ১৭টি পর্যায়ে তাদের ভাগ করলেন। ভেঙে দেখালেন রবীন্দ্র গানের বৈচিত্র্য।"
‘রবীন্দ্র সংগীতের ধারা’ নামক গ্রন্থে শুভ গুহঠাকুরতা বেঁধে ফেললেন রবীন্দ্রনাথের গানেদের। এই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে।
শুধু নিজের লেখা নয়, দক্ষিণী থেকে প্রতি বছর প্রকাশিত হত গান বিষয়ক পত্রিকা। গান যে শুধু গাওয়ার নয়, পড়ারও, তাই যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীত চর্চা নিয়ে সেই সব পত্রিকায় কলম ধরেছেন প্রশান্ত মহলানবীশ, প্রফুল্ল চন্দ্র মহলানবীশ, রানি চন্দ, অজিত কুমার দত্ত, অজিত চক্রবর্তী, শান্তিদেব ঘোষের মতো সঙ্গীত জগতের ব্যক্তিত্বরা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বই প্রকাশ ছাড়াও নিয়ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রোতার কান তৈরি করতে শুরু করলেন তিনি। সেই সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীরা এসে অনুষ্ঠান করতে আরম্ভ করেন দক্ষিণী ভবনে। আলাউদ্দিন খাঁ থেকে রবিশঙ্কর, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষ শুভ গুহঠাকুরতার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন। এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আক্ষেপ মেটাতে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে গাটছড়া বেধে সুরের রবীন্দ্রনাথকে আজীবন নির্মাণ করে চলেছিলেন তিনি।
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১০ জুলাই দক্ষিণী আয়োজন করেছে এক বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান। দেশ-বিদেশের ছাত্রছাত্রীরা গানের মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন। এই অনুষ্ঠান দক্ষিণীর ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে সন্ধে ৬টায় শোনা যাবে। অন্য দিকে অপার বাংলা টরোন্টোর ফেসবুক পেজ থেকেও শুক্রবার রাত ৮টা থেকে শোনা গিয়েছে শুভ গুহঠাকুরতার জন্মদিনের বিশেষ সঙ্গীতের শ্রদ্ধাঞ্জলি।