(বাঁ দিক থেকে) সন্দীপ্তা সেন, পিয়া চক্রবর্তী, ইমন চক্রবর্তী, উষসী চক্রবর্তী, নীল ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
‘‘বিদেশে যদি বিয়ের আংটি পরা যায়, তা হলে এখানে শাঁখা-পলা পরতে অসুবিধা কোথায়?’’ সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমের কাছে এমনই মন্তব্য করেছেন অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর। আনন্দবাজার অনলাইনের এক সাক্ষাৎকারে প্রথম মেয়েদের শাড়ি পরার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
সেই বক্তব্য আলোড়ন ফেলেছিল সর্বত্র। এ বার উঠে এল শাঁখা-পলার প্রসঙ্গ। তিনি মনে করছেন, বর্তমান সময়ে অনেকেই শাঁখা-পলা পরেন না। সনাতনী বিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন অনেকেই। শুটিং এর প্রয়োজনে শাঁখা-পলা খুলতে হলেও, নোয়া কখনও খোলেননি বলেও জানান মমতা শঙ্কর। তিনি তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন।
তবে বিয়ের আংটির সঙ্গে শাঁখা পলার তুলনা মেনে নিচ্ছেন না মনো-সমাজকর্মী পিয়া চক্রবর্তী। আনন্দবাজার অনলাইনকে পিয়া বলছেন, ‘‘বিয়ের আংটির সঙ্গে শাঁখা পলার তুলনাটা ঠিক নয়। কারণ বিয়ের আংটি স্বামী-স্ত্রী উভয়েই পরেন। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু মহিলাদের শরীরেই বিবাহিত হওয়ার চিহ্ন থাকে। পুরুষের তেমন কোনও চিহ্ন থাকে না। তাই এই তুলনাটা যুক্তিপূর্ণ নয়। তবে কেউ যদি নিজে থেকে পরতে চান, সেটা তাঁর পছন্দ-অপছন্দ। পরা উচিত বা অনুচিত, সেটা আমি বলার কেউই নয়।’’
সম্প্রতি অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছেন পিয়া। তবে নিজে শাঁখা-পলা বা সিঁদুর বা নোয়া পরেন না বলে জাানান তিনি। পিয়া বলছেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করি, বিবাহিত বোঝানোর জন্য শরীরে চিহ্ন রাখার প্রয়োজন নেই।’’
কিছু দিন আগেই সাত পাকে বাঁধা পড়েছেন অভিনেত্রী সন্দীপ্তা সেন। নিয়মিত শাঁখা-পলা পরতেই হবে, এমন ভাবনায় বিশ্বাস করেন না তিনি। সন্দীপ্তা বলছেন, ‘‘আমি আমার মাকেও সর্ব ক্ষণ দু’হাতে শাঁখা-পলা পরে ঘুরতে দেখিনি। আমার আশপাশের বহু বয়স্ক মানুষকেও বলতে শুনেছি যে, তাঁদের যখন ইচ্ছে হয়, তখন তাঁরা পলা পরেন। ইচ্ছে না হলে পরেন না। এটা দেখেই বড় হয়েছি। তাই এ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। আমার পরিবারের চিন্তাভাবনা এমনই। আমার দিদা সেই সময়ে ৩৫ বছর বয়সে বিয়ে করেছেন। আমার ঠাকুমা আমার মাকে শাঁখা-পলা পরার জন্য কখনও জোর করেননি। ’’
সন্দীপ্তা মনে করছেন, নিজের ইচ্ছেটাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘আমাদের বাড়িতে নিয়ম আছে, উপোস করে পুজো করা যাবে না। আত্মাকে কষ্ট দিয়ে পুজো মন দিয়ে করা যায় না। প্রতিটি পরিবার ভিন্ন ভাবে শিক্ষা দেয়। কোনও শিক্ষাই ভুল নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব মত রয়েছে। আমি এখন শাঁখা-পলা পরি না। বিয়ের পরে প্রথম এক মাস পরেছিলাম ভাল লাগত বলে। তা ছাড়া বার বার শুটিং এর জন্য শাঁখা-পলা খোলা বা সিঁদুর পরে বার বার মোছা বিষয়টা আমার খারাপ লাগে। তাই পেশার জন্যই ঠিক করেছি, পরব না। বাড়িতে পুজো হলে পরি।’’
পুরুষদের শরীরে কোনও চিহ্ন থাকে না বিয়ের পরেও। এই বিষয়ে সন্দীপ্তা বলছেন, ‘‘আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আছি। যদিও আমি সৌম্যকে সিঁদুর পরিয়েছি বিয়েতে। আমরা দু’জনই আংটি পরি। আমি হাতে নোয়া পরি। কারণ এগুলো বার বার খুলতে হয় না।” তিনি আরও বলছেন, ‘‘আগে মহিলাদের পরতে বলা হত, তাই তাঁরা পরতেন। আজ নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছেন।’’ সন্দীপ্তার ঠাকুমা এক স্কুলের অধ্যক্ষা ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি আমার ঠাকুমা ও দিদাকে নিয়ে খুব গর্বিত।’’
গায়িকা ইমন চক্রবর্তী অবশ্য শাঁখা-পলা পরতে পছন্দ করেন বলে জানিয়েছেন। যদিও কোনও কিছু জোর করে পরানোকে সমর্থন করেন না তিনিও। আজকাল অনেক অবিবাহিতও পোশাকের সঙ্গে শাঁখা-পলা পরছেন। ইমন বলছেন, ‘‘কেউ যদি শুধুই সাজের জন্য পরে থাকেন সেটাও ঠিক আছে। আবার কেউ যদি রীতি মেনেও পরেন, সেটাও তাঁদেরই ব্যাপার। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল, বিয়ে হলে শাঁখা-পলা পরব, আমার ঠাকুমাকে দেখেছিলাম শাঁখা-পলা, সিঁদুর পরতে। সব সময় শাঁখা-পলা হয়তো পরা হয় না। কিন্তু বিবাহিত মহিলার যা যা রীতি, তা আমি পালন করতে ভালবাসি। কেউ যদি আনন্দের সঙ্গে এগুলি করেন, তা হলে সেখানে কোনও ভুল নেই।’’
শুধু মহিলাদের জন্যই বিয়ের চিহ্ন প্রসঙ্গে ইমন বলছেন, ‘‘আমি একটি খবরে দেখেছিলাম, স্বামী তাঁর পদবি পরিবর্তন করছেন। সেটাও তো হচ্ছে। আমি ট্রোলড হয়েছিলাম বিয়ের পরের দিন শাঁখা-পলা খুলে মঞ্চে অনুষ্ঠান করায়। আনন্দের সঙ্গে যেটাই করা হবে তাতে কোনও ভুল নেই।’’
বিয়ে করেননি। তবে অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তী সাজের জন্য মাঝেমধ্যে শাঁখা-পলা পরেন। তিনি বলছেন, ‘‘অবিবাহিত বা বিধবারাও শাঁখা-পলা পরে সাজতেই পারেন। আমি এবং আমার কয়েক জন অবিবাহিত বন্ধুও পরে। কোনও বিবাহিত মহিলা যখন স্বেচ্ছায় শাঁখা-পলা পরেন সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা তখনই, যখন বাধ্য হয়ে এগুলি পরতে হয়। বিয়ের আংটির তুলনাটা অবান্তর। পশ্চিমের দেশে মহিলাদের আরও সুবিধা আছে যেগুলি আমরা ভোগ করি না।’’‘জেন্ডার স্টাডি’ নিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘আমাদের দেশে ছেলেদের কোনও বিবাহচিহ্ন নেই। তা হলে মেয়েদের কেন বাধ্যতামূলক ভাবে এই বিবাহচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হবে, প্রশ্নটা সেখানেই। না মানলেই তাকে নানা কটূক্তি শুনতে হয়। নিজের পছন্দ-অপছন্দ মেনে পরুক তাতে কোনও অসুবিধা নেই। এর মধ্যে লিঙ্গ রাজনীতি রয়েছে। যখনই বাধ্যতামূলক ভাবে করতে হচ্ছে, তখনই সেটা হয়ে যায় পুরুষতন্ত্র। এটা কেন কেউ বলছেন না, জানি না।’’
অভিনেতা নীল ভট্টাচার্য এই বিষয়ে বলছেন, ‘‘বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে। কিন্তু দিনের শেষে, যে মানুষটা পরছেন, তাঁর ইচ্ছের উপর সবটা নির্ভর করে। শাঁখা-পলা হোক বা সিঁদুর বা মঙ্গলসূত্র— পরতে ইচ্ছে হলে পরবেন। কিন্তু আসল বিষয় হল, এক জনের আর এক জনের প্রতি ভালবাসা আছে কি না। বাইরে থেকে আমরা অনেক কিছু পরতে পারি। কিন্তু ভিতর থেকে কী ভাবছি সেটা জরুরি। ভিতর থেকে একজনকে সহ্য করতে পারছি না, কিন্তু বাইরে শাঁখা-পলা পরছি সেটা কাম্য না। ইউনিফর্ম তো আমরা স্কুলেও পরি। যে যেটায় খুশি, সেটাই করা উচিত।’’