Dahaad Review

ক্রাইম থ্রিলারে মোড়া সামাজিক পচনের গল্প, কেমন হল ‘দহাড়’? জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন

মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই নজরে ছিল জ়োয়া আখতার ও রীমা কাগতির ওয়েব সিরিজ়। বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর এ বার কানেও স্বীকৃত ‘দহাড়’।

Advertisement
স্নেহা সামন্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৩ ২০:০১
Sonakshi Sinha in Dahaad

সাব-ইন্সপেক্টর অঞ্জলি ভাটির ভূমিকায় ‘দহাড়’ সিরিজ়ে দাগ কেটেছেন সোনাক্ষী সিন্‌হা। ছবি: সংগৃহীত।

‘মেড ইন হেভেন’, ‘ইটারনালি কনফিউজ়ড অ্যান্ড ইগার ফর লভ’-এর পরে ফের ওয়েব সিরিজ়ে ফিরলেন পরিচালক-প্রযোজক জ়োয়া আখতার। রীমা কাগতির সঙ্গে জুটি বেঁধে ফিরলেন ‘দহাড়’ নিয়ে। ১২ মে এক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেল ‘দহাড়’। প্রচারের ঘনঘটা তেমন ভাবে না থাকলেও মুক্তির আগে থেকেই চর্চায় ছিল জ়োয়া আখতার ও রীমা কাগতির এই সিরিজ়। প্রথম ভারতীয় সিরিজ় হিসাবে চলতি বছরেই বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তথা বার্লিনেলে জায়গা করে নিয়েছিল ‘দহাড়’। এ বার কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্বীকৃতি পেল সোনাক্ষী সিন্‌হা, বিজয় বর্মা, গুলশন দেবাইয়া ও সোহম শাহ অভিনীত এই সিরিজ়।

বাণিজ্যিক অথচ সংবেদনশীল ঘরানার ছবি নির্মাতা হিসাবে বলিউডে নামডাক আছে জ়োয়া আখতারের। ‘লাক বাই চান্স’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসাবে হাতেখড়ি হওয়ার পরে ‘জ়িন্দেগি না মিলেগি দোবারা’, ‘দিল ধড়কনে দো’, ‘গলি বয়’-এর মতো ছবির নেপথ্যে থেকেছেন জ়ো়য়া। সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের সহযোগী রীমা কাগতি। উচ্চবিত্ত সমাজের নিত্যদিনের জীবনযাপনকে যেমন সফল ভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন জ়োয়া, তেমনই সমাজের তুলনামূলক ভাবে আঁধারি দিকেও ক্যামেরার লেন্স ঘোরানোর কাজ শুরু করেছেন ‘তলাশ’-এর মতো ছবির মাধ্যমে। ‘গলি বয়’ ছবিতেও ঝাঁ- চকচকে মায়ানগরীর রোজনামচার মাঝে প্রাধান্য পেয়েছে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক শিল্পীর স্বপ্নের উড়ান। ‘দহাড়’ সিরিজ়ে সেই একই চেষ্টায় আরও শান দিয়েছেন জ়োয়া আখতার ও রীমা কাগতি।

Advertisement
Vijay Varma in Dahaad

এক দিকে নম্র স্বভাবের শিক্ষক, অন্য দিকে ধূর্ত সিরিয়াল কিলার-চরিত্রের দ্বৈত সত্তাকে সুচারু ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বিজয় বর্মা। ছবি: সংগৃহীত।

‘দহাড়’-এর শুরু সোনাক্ষী সিন্‌হার চরিত্র অঞ্জলি ভাটির ক্যারাটে অভ্যাসের দৃশ্য দিয়ে। একের পর এক পুরুষ প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করছে অঞ্জলি। ডোজো (যেখানে মার্শাল আর্টস অভ্যাস করা হয়) থেকে বেরোনোর সময় বাকি সব পুরুষ তাদের প্রশিক্ষকের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেও, তার সামনে মাথা নোয়াতে নারাজ অঞ্জলি। প্রথম এই কয়েকটি দৃশ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়, রাজস্থানের মণ্ডওয়ার মতো মফস্‌সলের মেয়ে হলেও মানসিকতার দিকে দিয়ে অনেকটা আধুনিক সে। মায়ের পাশে বসে পুজো করার মতো সময় তার নেই। বরং, ক্যারাটে অভ্যাস করার পরেই অফিসে ছোটে অঞ্জলি। মণ্ডওয়া পুলিশ স্টেশনে সাব-ইন্সপেক্টর সে। সেখানে দেখা মেলে গুলশন দেবাইয়ার চরিত্র দেবী সিংহের। থানার বড়বাবু হলেও তথাকথিত বড়বাবুর সঙ্গে তার চরিত্রের কোনও মিল নেই। দেবী সিংহ বরং কর্মঠ ও সৎ এক জন পুলিশকর্তা। লিঙ্গের বিচারে নয়, যোগ্যতার উপর ভর করে সহকর্মীদের কাজের দায়িত্ব দেয় সে। অন্য দিকে, বিজয় বর্মাকে দেখা যায় একটি কলেজে হিন্দি সাহিত্যের ক্লাস নিতে। তাঁর চরিত্র আনন্দ স্বর্ণকার পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে শিক্ষকতার কাজ করে। পাশাপাশি, সাক্ষরতা অভিযানের মতো সমাজসেবার কাজেও মন আছে তার। রহস্যের সূত্রপাত হয় যখন কৃষ্ণা নামের এক তরুণীর নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট দায়ের করতে থানায় আসে তার দাদা। মাস খানেক ধরে নাকি খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তার। বাড়িতে ফোনও আসেনি। চিন্তায় পড়ে পুলিশের দ্বারস্থ হয় সে। সেই মামলার রহস্যভেদ করতে গিয়ে জানতে পারা যায়, গোটা রাজস্থান জুড়ে ২৭ জন তরুণী নিখোঁজ। অনেকের মৃতদেহও উদ্ধার হয়েছে ইতিমধ্যে। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় আত্মহত্যা। তবে তদন্তে নেমে ওই সব নিখোঁজ তরুণীর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পায় অঞ্জলি ভাটি। তদন্ত যত এগোতে থাকে, ততই স্পষ্ট হয় অঞ্জলির সিরিয়াল কিলার তত্ত্ব।

এ দিকে আনন্দ স্বর্ণকার সমাজে নিপাট এক ভাল মানুষ নামেই পরিচিত। মন দিয়ে শিক্ষকতা করে, সপ্তাহান্তে বেরিয়ে পড়ে সমাজকল্যাণের মতো মহৎ কাজে। বাড়িতে তার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গেও বেশ নরম সম্পর্ক তার। কাউকে খুন করা তো অনেক দূর, কারও উপর কখনও রাগতে, বা কারও সঙ্গে জোর গলায় কথা বলতেও কেউ দেখেনি তাকে। আনন্দের সম্বল বলতে তার মোবাইল ভ্যান, যাতে বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন রকমের বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে একটি ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বাক্স। ওই ভ্যানই সাক্ষী আনন্দের দ্বৈত জীবনযাপনের। অথচ সেখানে তল্লাশি করেও মেলে না কোনও পোক্ত প্রমাণ।

এ দিকে যত দিন এগোতে থাকে, আনন্দের উপর সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে অঞ্জলি ভাটি ও দেবী সিংহের। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না মিললে স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে কী ভাবে তাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করবে তারা? আদৌ কি ২৭ জন নিখোঁজ তরুণীর মামলার রহস্যভেদ করতে পারবে অঞ্জলি? খুনি ও পুলিশের এই ‘চেজ়’-এর আধারেই তৈরি ‘দহাড়’। গতে বাঁধা ‘হু ডান ইট’ থ্রিলার নয়, বরং এক সমান্তরাল যাপন ধরা পড়ে জ়োয়া আখতার ও রীমা কাগতির এই ওয়েব সিরিজ়ে। কিছু জায়গায় সুতো আলগা হলেও অত্যন্ত সুচারু ভাবে সিরিজ়ের চিত্রনাট্য বেঁধেছেন তাঁরা।

অভিনয়ের দিক থেকে একে অপরকে টেক্কা দিয়েছেন বিজয় বর্মা ও গুলশন দেবাইয়া। সিরিজ়ের মুখ সোনাক্ষী সিন্‌হা হলেও বিজয় ও গুলশনের উপর থেকে চোখ সরে না। বলিউডের বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির নায়িকা হিসাবে পরিচিত হলেও ‘দহাড়’-এ চমক লাগিয়েছেন সোনাক্ষী। কিছু দৃশ্যে তাঁর বলিউড নায়িকার সত্তা প্রকাশ পেলেও গোটা সিরিজ়ে ধারাবাহিক ভাবে বিশ্বাসযোগ্য ‘লুটেরা’ খ্যাত অভিনেত্রী। বিশেষত ‘দবং’, ‘রাউ়ডি রাঠৌর’-এর মতো ছবিতে কাজ করার পরে ‘দহাড়’ সোনাক্ষীর জন্য এক বড়সড় উত্তরণ। পার্শ্ব চরিত্রে সোহম শাহ অনবদ্য। বিশেষত তাঁর চরিত্র কৈলাস পার্ঘি সিরিজ় জুড়ে যে ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছে, তা মনে থাকার মতো। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে হোঁচটও খেয়েছে ‘দহাড়’। সিরিজ়ের প্রথমে যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা করেছিলেন নির্মাতারা, তা প্রায় অপ্রয়োজনীয়।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক থেকে নয়, বরং সেই প্রসঙ্গকে যথার্থ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ সিরিজ়ের চিত্রনাট্য। কিছু ক্ষেত্রে একাধিক চরিত্রের যে মূল গল্প, তা-ও হালকা করে ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন নির্মাতারা। যেমন বাবা হওয়ার খবর পেয়ে যে থতমত খেয়ে যায় পার্ঘি, তার কারণ পরিষ্কার হয়নি শেষ পর্যন্ত। অন্য দিকে, অঞ্জলি ভাটি যোগ্য পুলিশকর্মী হলেও সে যে সময়ে সময়ে কেন এত রুক্ষ, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যে। তবে, যে ভাবে জাতপাতের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে সিরিজ়ে, তা প্রশংসনীয়। স্রেফ পদবির বিচার করে এক পুলিশকর্মীকে অনায়াসে বাড়িতে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করা, নিচু জাতের কারও উপস্থিতিতে ধূপ জ্বালানোর মতো ঘটনা দেখে অবাক হতে হয়। দেশের অধিকাংশ এলাকায় যে এখনও এমন রেওয়াজ থেকে গিয়েছে, সেই ‘রিয়্যালিটি চেক’ তথাকথিত ভদ্রসমাজের পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর।

‘দহাড়’ সিরিজ়ের মাধ্যমে সিরিয়াল কিলিংয়ের মোড়কে দেশের সামাজিক পচনকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন জ়োয়া আখতার ও রীমা কাগতি। ১০ বার সেই লক্ষ্যে তির ছুড়লে ৮ বার লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছেন নির্মাতারা। সর্বোপরি, নিজেদের ‘কমফোর্ট জ়োন’ থেকে বেরিয়ে এই সিরিজ়ের মাধ্যমে নতুন ধরনের কনটেন্ট দর্শককে উপহার দিতে সফল হয়েছেন তাঁরা। এত দিন ‘সেক্রেড গেমস’, ‘মির্জ়াপুর’-এর সৌজন্যে গতে বাঁধা অন্ধকার জগতের গল্প পর্দায় দেখেছেন দর্শক। তথাকথিত সভ্য সমাজেও যে লুকিয়ে থাকে আনন্দ স্বর্ণকারের মতো ভয়াবহ বিপদ, তার প্রমাণ দিল ‘দহাড়’।

আরও পড়ুন
Advertisement