ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলায় গোয়েন্দাদেরই বাজার। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শবর, একেন— সফল গোয়েন্দারা বেশির ভাগই সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা। তবে কয়েক জন তারই মাঝে ফাঁক পেয়ে গোল দেয়। যেমন গোল দিয়েছিল ‘গোরা’। কোনও সাহিত্যনির্ভর গল্প নয়, ওটিটf-র মঞ্চে মৌলিক সৃষ্টি। কিন্তু সে খুব একটা গোয়েন্দাসুলভ নয়। আধপাগলা, খ্যাপাটে, খিটখিটে, বেসুরো গান গেয়ে আশপাশের মানুষকে জ্বালিয়ে মারা ভুলো এক গোয়েন্দা। যে আর পাঁচজন গোয়েন্দার চেয়ে তার সহকারী সারথির উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাকে ছাড়া প্রায় অচলও বলা যায়। নায়কসুলভ গোয়েন্দাদের ভিড়ে সে উদ্ভট হলেও দিব্যি জায়গা করে নিতে পেরেছিল বাঙালি দর্শকের মনে। প্রথম সিজ়নের শেষে দর্শকের মনে একটাই প্রশ্ন ছিল— ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং সুহোত্র মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি ফের কবে পর্দায় দেখা যাবে?
প্রথম সিজ়নে ‘গোরা’ জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তাতে বেশ কিছু গলদ ছিল। গল্পে কমেডির অংশ যতটা ভারী, যতটা মুনশিয়ানার সঙ্গে লেখা হয়েছিল, রহস্যের জাল ততটা মজবুত ছিল না। নির্মাতারা গোরার চরিত্রের উপর এত বেশি নজর দিয়েছিলেন যে, আসল কেসটা সে ভাবে জমেনি। ফাঁক ছিল রহস্য উন্মোচনের দিকেও। কিন্তু দ্বিতীয় সিজ়নে এই দুই দিকেই সমান নজর পড়েছে। এই সিজ়নে গোরার উপর সারথির মতো বেশ কিছু দর্শক যতই বিরক্ত হয়ে যান না কেন, তার যাবতীয় কাণ্ডকারখানার আসল মাহাত্ম্য বোঝা যাবে শেষের দিকে। গোয়েন্দা গল্পের ভক্তেরা ভালই জানেন, সাধারণত অপরাধী চেনা চরিত্রদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। কোনও গল্পের শেষে যদি একদম নতুন কোনও চরিত্রকে অপরাধী হিসাবে আনা হয়, তা হলে পাঠকেরা সেই গল্পকে অত্যন্ত কাঁচা বলেই ধরে নেন। গোয়েন্দা গল্পের শেষে অপরাধীর নাম বলে দেওয়ার আগেই যদি অধিকাংশ পাঠক ধরে ফেলেন সে কে, তা হলেও গল্পের মান পড়ে যায় বইকি। এই সিজ়নে গোরার খ্যাপামি খুব সুন্দর করে ব্যবহার করেছেন গল্পকার সাহানা দত্ত এবং পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। এখানে দর্শক গোরাকে দেখতেই এত ব্যস্ত থাকবেন যে, আসল অপরাধী কে, তা অনেক ক্ষণ ধরতে পারবেন না।
আগের সিজ়নে ঠিক যেখানে গল্প শেষ হয়েছিল, এ বার প্রায় সেখান থেকেই শুরু হয়। শুধু মাঝের কিছুটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সোমলতা (ইশা সাহা) গোরার জীবন থেকে সরে গিয়েছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় গোরাও বেঁকে বসেছে। তার বিয়ে না হওয়া অবধি কঙ্কা এবং সারথির বিয়েও সে হতে দেবে না বলে বাড়ির লোককে শাসিয়েছে। তারই মাঝে নতুন কেস এসে যায়। বেশ কিছু বাচ্চা একই ভাবে রক্তবমি করে মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি অবশ্য অন্য আরও একটি কেস আসে গোরার কাছে। ঠিক আগের বার যেমন সোমলতার কেস এবং মূল কেসের তদন্ত একসঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিল গোরা। কিন্তু এ বারে একটি ফারাক আছে। দুটি কেস বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সুন্দর ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কিছু পর্বের পর থেকেই।
এই সিজ়নের চিত্রনাট্য অনেকটাই জমাট। মন দিয়ে একটি সিরিয়াল কিলারের গল্প সাজানো হয়েছে। অবশ্যই কিছু অংশ অতিরঞ্জিত। কিন্তু সেগুলিকে সৃজনশীল স্বাধীনতার খাতিরে মার্জনা করা যায়। ঠিক যে যে মুহূর্তে গোরার উদ্ভট আচরণ দমফাটা হাসির বদলে বিরক্তি উদ্রেক করবে, ঠিক তখনই রহস্যের নতুন কোনও ক্লু পাওয়া যাবে। তাই শেষ অবধি দর্শকের উৎসাহ ধরে রাখতে পেরেছেন পরিচালক। বাংলায় সিরিয়াল কিলিংয়ে গল্প নতুন নয়। বহু বার হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কোনও ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই অপরাধী খুনগুলি করছে। প্রতিশোধ অবশ্যই সিরিয়াল কিলিংয়ের নেপথ্যের একটি বড় মোটিফ। কিন্তু একমাত্র নয়। এক জন সাধারণ খুনি আর সিরিয়াল কিলারের মধ্যে ফারাক অনেক। এবং সেই ফারাক তৈরি হওয়ার কারণও অনেক। অনেক দিন পর প্রতিশোধ ছাড়া অন্য কোনও কারণে সিরিয়াল কিলিং দেখানো হয়েছে বলে দেখে ভাল লাগল। যদিও সেই কারণটা আরও জোরালো ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন নির্মাতারা। শেষটা একটু তাড়াহুড়ো করে লেখা মনে হতে পারে। তা সত্ত্বেও ক্লাইম্যাক্সের চমক মন্দ নয়।
ঋত্বিক চক্রবর্তীর ঘাড়ে এখানে গুরুদায়িত্ব ছিল। গল্পের কমেডির অংশ অনেকটাই তাঁর অভিনয়ের উপর দাঁড়িয়ে। এ বার অবশ্য তার কিছুটা দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন ইন্সপেক্টর সরকেলের ভূমিকায় অভিজিৎ গুহও। দু’জনের একসঙ্গে বেশ কিছু দৃশ্য সিরিজ়ের সবচেয়ে হাস্যকর মুহূর্তগুলি তৈরি করে। ঋত্বিক বরাবরের মতোই সাবলীল। সে গলা ছেড়ে বেসুরো গান গাওয়াতেই হোক, পাগড়ি-জোব্বা পরে অদ্ভুত ভাবে হাঁটাচলা করাতেই হোক কিংবা শেষে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ‘আমি তো বন্দুক হাতে অপরাধীর পিছনে ধাওয়া করতে পারি না’ বলে আফসোস করাতেই হোক।
ঋত্বিকের অভিনয় এখানে ‘ইং’ হলে সারথির ভূমিকায় সুহোত্র মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় ‘ইয়্যাং’। ঋত্বিক এখানে যতটা ‘লাউড’, সুহোত্রের অভিনয় ততটাই শান্ত। সারথি যখন ঠান্ডা মাথায় বন্ধুর খ্যাপামি সামলাচ্ছে তখনও, আবার যখন অধৈর্য হয়ে রাগে ফেটে পড়ছে তখনও— দুই ক্ষেত্রেই সুহোত্র তাঁর মাপা অভিনয় দিয়েই ঋত্বিকের মতো অভিনেতার পাশে দাঁড়িয়েও আলাদা করে নজর কাড়েন।
অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন অনন্যা সেন, অনুরাধা রায়, ঊষসী রায় এবং মানালি দে। গতে বাঁধা চরিত্রের বাইরে অন্য রকম চরিত্রে সুযোগ পেয়ে মন খুলে অভিনয় করেছেন মানালি। এ বারের গল্পে ঋত্বিক-সুহোত্র-অভিজিতের অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর কথাও আলাদা করে মনে থাকবে দর্শকের।
পর্দায় নানা রকম ফেলুদা-ব্যোমকেশের ঠেলাঠেলিতে গোরা যেন একটা টাটকা বাতাস। এই সিজ়নেও কিছু বাড়তি দৃশ্য আছে। যেগুলো বাদ দিলে হয়তো পর্বের সংখ্যা কিছুটা কমে যেত। অহেতুক পর্ব বাড়ানোর লোভ সামলাতে পারলে আগামী সিজ়নগুলিতে আরও ধারালো হতে পারে এই সিরিজ়।