Bijoya Review

হস্টেলে ছাত্রের রহস্যমৃত্যুর ঘটনা কতটা যুক্তিসঙ্গত ‘বিজয়া’য়? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন

কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালের হস্টেলে ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুরসমান্তরালে কি ‘বিজয়া’র টেক্সটকে দেখা সম্ভব?এখনও পর্যন্ত বাস্তবঘটনাটি সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে, তার চরিত্র এতখানি রৈখিক নয়।

Advertisement
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪ ১৩:৩৭
Image of Saheb Chatterjee and Swastika Mukherjee

ছবির দৃশ্যে সাহেব চট্টোপাধ্যায় ও স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

কলকাতার বুকে এক বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে এক নবীন ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তৈরি করা সিরিজ় ‘বিজয়া’ প্রথমেই সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া এক সত্য ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। নাকি, সেই সত্য ঘটনাটিকে মনে রাখতেই এই সিরিজ় তৈরি হয়েছে! এ এক দোলাচল বটে। গণস্মৃতিতে যখন প্রকৃত ঘটনাটি প্রায় ফিকে হয়ে এসেছে, তখন, তার দিকেই ইঙ্গিত রেখে নির্মিত ওয়েব সিরিজ় এক ‘বিশেষ’ উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত রাখে। সিরিজ়ের নামভূমিকার অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সমাজমাধ্যমে হট্টগোল কিছু দিনের মধ্যেই গণস্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিন্তু‘বিজয়া’র মতো সিরিজ় নির্মিত হলে, তা মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা দুরূহ। অর্থাৎ কিনা গোড়া থেকেই সায়ন্তন ঘোষাল পরিচালিত সিরিজ়‘বিজয়া’ এক রকম সামাজিক দায়বোধের ভার নিজের কাঁধে রেখেছিল। এখনও পর্যন্ত বিচারাধীন ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করতে গেলে যে জিনিসটি সর্বাগ্রে লাগে, তার ভালনাম ‘সৎসাহস’। সিরিজ় দেখতে বসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত দর্শক সেই বিশেষ বস্তুটি পর্দায় দেখতে পাবেন বলে আশা রাখেন। কিন্তু সিরিজ় শুরু হলে…?

Advertisement

গোড়া থেকেই এ সিরিজ়ের নির্মাণ দুর্বল। বয়েজ় হস্টেলের দৃশ্যের আরম্ভ পরিপার্শ্বের এমন সব সংলাপ দিয়ে, যার উচ্চারণ শুনেই মনে হয় কষ্টকল্পিত সব সংলাপ, যেন কিছু অনিচ্ছুক অভিনেতাকে দিয়ে আওড়ানো হচ্ছে। নৈহাটির বিধবা গৃহবধূ বিজয়া আর তার ছেলে নীলাঞ্জনের সংলাপেও আড়ষ্টতা গোড়া থেকেই। মা আর ছেলের সম্পর্ক বিন্যাসকে সর্বদাই কেন ‘সোনা ছেলে’-সুলভ উচ্চারণে বাঁধতে হবে, তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়। সে ধন্দ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের মতো বহুবিধ চরিত্রে অভিনয় করে আসা ব্যক্তিত্বও ঘোচাতে পারেন না। নীলাঞ্জনের কলকাতার নামী কলেজে পড়তে আসা এবং হস্টেলের তিনতলার বারান্দা থেকে তার পড়ে যাওয়া এবং তার পর মা বিজয়ার অসহায়তাও যে চিত্রনাট্য খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গে নির্মাণ করতে পেরেছে, তা মনে হয়নি।

Image of Swastika Mukherjee and Bidipta Chakraborty

ছবির একটি দৃশ্যে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ও বিদীপ্তা চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

কাহিনি এগোয় এমন এক ছাঁদে, যার সঙ্গে বাংলা টেলিভিশনের মেগাসিরিয়ালের ‘বাইনারি’ ভাল-খারাপ, সাদা-কালোর ব্যাকরণের তেমন কোনও পার্থক্য নেই। যে খারাপ, সে অবিমিশ্র খারাপ আর যে ভাল, সে অনিঃশেষ রকমের ভাল— এই ছাঁদ আশির দশকে বাংলা ছবিতে দেখা যেত। খলনায়ক মিহির গুপ্ত (সাহেব চট্টোপাধ্যায়) সর্ব অর্থেই দুর্নীতিগ্রস্ত, তার নৈতিক অবস্থান বোঝাতে আজ এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েও যদি তাকে মদ্যপায়ী দেখানো হয়, তা হলে খানিক বিড়ম্বনা তৈরি হয় বইকি! ছেলের কুকীর্তি থেকে শিক্ষা দুর্নীতি, সবই মিহির গুপ্তের অঙ্গুলিহেলনে সম্পন্ন হয় আর সব কিছুকেই মিহির ‘মিষ্টির বাক্স’ (ভিতরে টাকা) দিয়ে ঢেকে দেয়। এমতাবস্থায় মিহিরের বখে যাওয়া ছেলে (খারাপ, তাই সে ড্রাগও নেয়)-র র‌্যাগিং সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে নীলাঞ্জন তিনতলা থেকে নীচে পড়ে যায়। মিহির তার যাবতীয় দাঁত-নখ-শুঁড় বার করে ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। শুরু হয় সহায়-সম্বলহীনা মা আর ক্ষমতাবানের অসম লড়াই।

এখানে কাহিনি যে একেবারে রৈখিক জ্যামিতি মেনেই উপস্থিত, তা প্রাঞ্জল। এই রেখা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বিজয়া মিডিয়ার উচ্চাভিলাষী কর্তার টিআরপি-লিপ্সার ফাঁদে পড়ে। পুলিশ তাকে এক রকম হাঁকিয়েই দেয়। কিন্তু, অবিমিশ্র খারাপের শহরে অবিমিশ্র ভালদেরও এ বার আবির্ভাব ঘটতে থাকে। নীলাঞ্জনদের কলেজের সাইকিয়াট্রিস্ট অনুরাধা দত্ত (বিদীপ্তা চক্রবর্তী) তার সহায় হয়। এর পর কাহিনির ছাঁদ খানিক গোয়েন্দাগিরির আর খানিক সেন্টিমেন্টের ওঠানামার। নীলাঞ্জনের সহপাঠী অহনকে খুঁজে বার করা এবং তার মায়ের বিজয়াদের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে একটা ‘নারীশক্তির একীকরণ’-এর ইঙ্গিত মেলে। এর পরে গল্প সেই চিরাচরিত দুষ্টের দমনের দিকেই ঢলে পড়ে। কিন্তু, অমন দুর্মদ দুষ্ট একটা কাচের ভাঙা বোতলের সামনে যে অত সহজে দুমড়ে পড়বে, সেটা কেমন যেন পানসে করে দেয় পুরো ব্যাপারটিকেই। অন্তিমে মাতৃত্বের জয় আর দেবীবন্দনা দিয়ে আবার বাংলা সিনেমায় বহুব্যবহৃত আয়ুধই দেখাল ‘বিজয়া’।

Review of the web series bijoya

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ

কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সমান্তরালে কি ‘বিজয়া’র টেক্সটকে দেখা সম্ভব? এখনও পর্যন্ত বাস্তব ঘটনাটি সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে, তার চরিত্র এতখানি একরৈখিক নয়। সেখানে সাদা-কালোর মাঝ বরাবর অনেক রঙের বর্ণালি, পঞ্চাশের অধিক ধূসরিমা ইত্যাদি রয়েছে। নগরালির দুষ্ট আর মফস্সলের শিষ্টের দ্বিমেরুতে তাকে দেখা যায় না। যায়নিও। ‘বিজয়া’কে যদি সেই ঘটনার অভিজ্ঞান হিসেবেও দেখা যায়, তা হলে বলতে হবে, কয়েক যুগ ধরে বলে আসা চিত্রভাষায় কথা বলা এই সিরিজ় কতখানি ‘মনে করাবে’ সেই মৃত ছাত্রটিকে, যে এখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত কারণেই উঁচু তলা থেকে আছড়ে পড়েছিল? তাঁর তরফে ঐকান্তিক চেষ্টা করেছেন স্বস্তিকা। তুলনায় নীলাঞ্জনের ভূমিকায় দেবদত্ত রাহা খানিক অপ্রতিভ। বন্ধু অহনের ভূমিকায় জিৎসুন্দর ভিন্ন ম্যানারিজ়মের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মনোশ্চিকিৎসকের ভূমিকায় বিদীপ্তাও সাবলীল। কিন্তু, আবারও মনে রাখা দরকার এক বিচারাধীন ঘটনাকে যখন গণস্মৃতিতে জাগরুক করার দায় ঘাড়ে তুলে নেয় চলচ্চিত্রের মতো কোনও শিল্পমাধ্যম, তখন বোধ হয় প্রয়োজন পড়ে বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখার। তুলনায় মনে পড়ে যায় মেঘনা গুলজ়ার পরিচালিত ‘তলভার’ (২০১৫) ছবিটির কথা। ২০০৮ সালে নয়ডায় ঘটে যাওয়া জোড়া খুনের ঘটনাকে মেঘনা পুনর্নির্মাণের প্রয়াস করেছিলেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে গড়ে তোলা ‘রশোমান এফেক্ট’-এর মাধ্যমে। যার অভিঘাত এই যে, ছবিটিকে এক বার দেখলেও ভোলা সম্ভব নয়। ‘বিজয়া’ বা তার সমধর্মী চলচ্চিত্র প্রচেষ্টার একরৈখিকতাই তাদের বিস্মৃত করে তুলবে, সন্দেহ থেকেই যায়।

আরও পড়ুন
Advertisement