কেমন হল ‘এলএসডি ২’? ছবি: সংগৃহীত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এসে গিয়েছে তাই আমাদের আর কাজ থাকবে না, এ রকম আলোচনা হচ্ছে আজকাল । হালফিলে প্রায় প্রবাদ হয়ে গিয়েছে এমন বাক্য। ফেসবুক আর হোয়াটস্অ্যাপ আসার পর থেকে আমাদের যোগাযোগের ভাষা বদলে গিয়েছে অনেক দিন হল। অতিমারির পর ডিজিটাল মাধ্যমের এমন রমরমা হবে, আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। ইউটউবার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, ব্লগার, ভ্লগার, মিম, রিলস, ফলোয়ার— এই শব্দগুলো কয়েক বছর আগেও অচেনা ছিল। আর আজ সিনেমা, থিয়েটার, উপন্যাসের বদলে শুধু নিজের মুখটা সমাজমাধ্যমে দেখেই খুশি থাকি আমরা, কার কত ফলোয়ার হল গুনতে থাকি দিনভর। পরিস্থিতি এমনই যে একজন ইউটিউবার রাজনীতি নিয়ে বেফাঁস কিছু বললে তাঁকে গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটে গিয়েছে কিছু দিন আগে।
দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়র ‘এলএসডি ২’ (লভ সেক্স অউর ধোকা ২) দেখতে গিয়ে এ কথাগুলোই মনে পড়ছিল বার বার। বছর চোদ্দো আগে দেখেছিলাম দিবাকরের ‘এলএসডি’ (লাভ সেক্স অউর ধোকা) ছবিটি। সে সময় সবে ডিজিটাল প্রযুক্তি এসেছে। দিবাকর সে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গোছানো প্রেমের বলিউডি গল্পকে প্রবল ব্যঙ্গ করেছিলেন, মনে আছে। খুলে নিয়েছিলেন তথাকথিত হিন্দি ছবির মুখোশ আর পরচুলা। দেখতে দেখতে গঁদারের কথা মনে পড়েছিল। প্রায় একই সময় অনুরাগ কাশ্যপ আর কিউ একই ভাবে ডিজিটাল মাধ্যমকে নানা ভাবে ব্যবহারে করে বিশ্ব মানচিত্রে বদলে দিয়েছিলেন ভারতীয় ছবির মাত্রা।
চোদ্দো বছর পর, প্রখর গ্রীষ্মে আর একবার দিবাকরের ‘এলএসডি ২’ চাখতে গিয়ে আবারও শক খেলাম চড়াম করে। একটু আগে গত চোদ্দো বছরের মিডিয়ার যে যে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কথা বললাম, প্রায় সব ক’টিই ধরেছেন দিবাকর এ ছবিতে। তিনটি পর্বে ভাগ করা এ ছবিতে ‘লভ’-এর সঙ্গে জুড়েছে ‘লাইক’, ‘সেক্স’-এর সঙ্গে জুড়েছে ‘শেয়ার’ আর ‘ধোকা’র সঙ্গে জুড়েছে ডাউনলোড শব্দগুলি। গত চোদ্দো বছরে লিঙ্গ নিয়েও আমাদের সচেতনতা বেড়েছে। তাই দিবাকরের এ ছবির গল্পগুলিতেও নানা লিঙ্গের মানুষের উপস্থিতি প্রকট। কোথাও তারা আক্রান্ত, কোথাও আবার তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবল ভাবে রিয়্যালিটি শোয়ে ভোগ্যপণ্যের মতো।
রিয়্যালিটি শোয়ের গল্প দিয়েই এ ছবি শুরু। যেন সিনেমা হলে সেই রিয়্যালিটি শো দেখতেই ঢুকেছি, এ ভাবেই সিনেমাটি শুরু হয়। প্রত্যেক ফ্রেমে ভেসে ওঠে প্রতিযোগীদের ভোটের অপশন, তার সঙ্গে নানা জিনিসের পপ-আপ। হাজারটা উইন্ডো একসঙ্গে খোলা, সবাই শুধু একটা ক্লিকের অপেক্ষায়। রিয়্যালিটি শোয়ে সত্যির মুখোমুখি হতে হতে দুনিয়াজোড়া দর্শকের সামনে নিজের প্রেমিকের সঙ্গে যৌনতা বা নিজের মাকে থাপ্পড় বা মা’র গাওয়া অশ্লীল গানে নাচ বা গোপন একান্ত ব্যক্তিগত মায়ের গঞ্জনা— কিছুই ব্যক্তিগত থাকে না। এক অনন্ত প্রতিযোগিতার এ হেন রিয়্যালিটি শোয়ে শেষমেশ স্টোভ ফেটে যখন প্রতিযোগিতার বিচারক অনু মালিক বাধ্য হন জানান দিতে, মাকে প্রকাশ্যে থাপ্পড় মারার প্রতিবাদ করছেন তিনি। এই একটি মুহূর্তে ছবিটি শুধু সততার সামনে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু তার পরেই মনে হয় এই সততাও তীব্র ফক্কড়ি না তো, কেননা স্ক্রিন জুড়ে ভেসে ওঠে রিয়্যালিটি শোয়ের প্রযোজকের হোয়াটস্অ্যাপ কল, যেখানে তিনি জানান, খেলা হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই যে ভাবেই হোক খেলা ঘোরাতে হবে। তবেই খেলা হবে। সে কথা জানিয়ে হাজারো ভ্লগার ভ্লগ বানাতে থাকেন ইউটিউবে।
মেসেঞ্জার, হোয়াটস্অ্যাপ কল ইত্যাদি আজকের সমস্ত সংযোগের মাধ্যমকেই গোটা ছবি জুড়ে দিবাকর ব্যবহার করেন। শেষ গল্পে তো তিনি বেশ কিছু ক্ষণ আমাদের মেটাভার্সেই নিয়ে চলে যান। আজকের প্রযুক্তির এ হেন ব্যবহার আগের কোনও ছবিতে এই মাত্রায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সিনেমা পরবর্তী নিউ মিডিয়ার এ হেন ব্যবহার দেখে তাই বিস্মিত হই, চমকে উঠি, নতুন, ভীষণ নতুন লাগে। তবে তার পরেই চিন্তার অন্ধকার ছেয়ে যায় মুখ জুড়ে। এ কোন ভবিষ্যতের দিকে চলেছি আমরা? স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় অভিনীত গল্পটিতে বড় সংস্থায় কর্মরত এক গরিব অন্য লিঙ্গের কর্মীকে যে ভাবে আক্রান্ত হতে হয় এবং তার পর কর্পোরেটরা নিজেদের নামের কালি মুছতে যে ভাবে ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়, তাতে মনে হয়, দেশের এই আপাত কর্পোরেট- চাকচিক্যের আড়ালে প্রতিদিন এ ভাবেই কত কত অসহায় গরিবকে মরে যেতে হচ্ছে বিনা বিচারে! রাগে যখন সেই কর্মী অফিসের সমস্ত বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তখন মনে হয়, মনে হয় সেই রাগ আসলে আমাদেরও। আমরা তা প্রকাশ করতে পারছি না, কিন্তু ওই গরিব মানুষটি তা দেখিয়ে ফেলল!
শেষ গল্পে এ অন্ধকার আরও তীব্র হয়। এক অল্পবয়সি ইউটিউবার ক্রমে জনপ্রিয় হতে হতে নিজের যৌনতার মুহূর্ত দেখাতেও দ্বিধাবোধ করে না। ‘ভিউয়ার’ বা ‘ফলোয়ার’ নামের রোগে আক্রান্ত এ সময়। তাই ভিউয়ার বাড়াতে তার স্কুল, তার বাবা-মা, তার মধ্যবিত্ত মনস্কতার বাড়ি, কাউকেই পাত্তা দেয় না সে। ছোটবেলা থেকে বাকিদের থেকে লিঙ্গগত ভাবে আলাদা হওয়ায় তার মনে যে জমা রাগ তা একদিন নিজেকে উলঙ্গ করে বিশ্বজোড়া মানুষের সামনে তুলে ধরায় প্রকাশ পায়। তার পর উইন্ডোর পর উইন্ডোতে নানা ব্লগ ও ভ্লগে তাকে নিয়ে চলে সাবস্ক্রাইবারদের আলোচনা। ছবির শেষে ছেলেটি মেটাভার্সের চশমা পড়ে তাকায় সবার দিকে। ট্রোলারেরা ট্রোল করতে থাকে। তার পর নিখোঁজ হয়ে যায় ছেলেটি। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায় অবতাররূপে মেটাভার্সে। সেখানে সংবাদ সঞ্চালকের অবতারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে জানায়, সে সমস্ত অসহায় মানুষকে এ বার বদলে দেবে, যারা নানা ভাবে ছোটবেলা থেকে নির্যাতিত। এ ভাবেই সে ক্রমে সুপারম্যান হয়ে ওঠে। খুলে যায় রূপকথার নিষ্ঠুরতা।
দিবাকরের এ ছবি শেষে হয়ে ওঠে সময়ের কান্না। চিৎকার। অসহায় আর্তনাদ। যিশুর হাতে পেরেক ছিল। আমাদের হাতে স্মার্টফোন। চোখে মাল্টিভার্স চশমা। সবার হাজার হাজার ফলোয়ার। আমাদের আর পালাবার পথ নেই।