মা ও মেয়ের টানাপড়েন পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন (ডান দিকে) কানি কুশ্রুতি ও প্রীতি পাণিগ্রাহী (বাঁ দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
‘বয়েজ় উইল বি বয়েজ়’— ইংরিজির এই চলিত প্রবাদ কানে লেগে রয়েছে, হয়তো বীজমন্ত্রের মতো। বাংলায় যেমন বলা হয় ‘সোনার আংটি বাঁকা হয় না’। নিত্যব্যবহৃত এ সব বাক্যবন্ধে আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ছেলেদের যে কোনও আচরণকে, বিশেষত অপরাধ প্রবণতাকে হালকা চালে এড়িয়ে যাওয়ার, প্রশ্রয় দেওয়ার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নেই।
এর বিপরীতে যদি বলা যায় ‘গার্লস ইউল বি গার্লস’! সত্যিই কি মেয়েদের কোনও আচরণকে এতটা স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ে দেখা হয়? ছোটবেলা থেকেই তাদের মনে বুনে দেওয়া হয় কোন কাজ করা যাবে, আর কোনটা করা যাবে না, তার নিরেট সংজ্ঞা। শুচি তালাতি তাঁর প্রথম ছবি ‘গার্লস উইল বি গার্লস’-এ দেখিয়েছেন তেমনই চেনা ছবির ঝকঝকে প্রতিবিম্ব।
উত্তর ভারতের পাহাড়ি এলাকার এক আবাসিক স্কুলের কড়া শিক্ষিকা মনেপ্রাণে লালন করেন পরিচিত সেই পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন। তাই রোজই প্রাণপণ চেষ্টা করেন ছাত্রীদের সহবত শেখাতে— স্কার্টের ঝুল যেন হয় হাঁটু পর্যন্ত, মোজা যেন গুটিয়ে খাটো করে পরা না হয়। আসলে ছোট স্কার্ট পরে মেয়েরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করলে তাদের বন্ধু ছাত্ররা সেই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলতে পারে। অপ্রীতিকর সেই পরিস্থিতি এড়াতে ছাত্রীদেরই তো উচিত নিজেদের জামাকাপড়ের ঝুল ঠিক রাখা! দিদিমণি চান না এ সব বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে তর্ক করে ‘অযথা’ ঝামেলায় জড়াতে।
সত্যিই তো, ছেলেদের কোনটা ঠিক, কোনটা অন্যায়— তা ছোটবেলা থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটুকুও এই সমাজ অনায়াসে এড়িয়ে যেতে চায়। শুধু মেয়েদের বেঁধে ফেলতে থাকে নিয়মের জালে। এমনই এক নৈতিক বেড়াজালে বিশ্বাসী আবাসিক স্কুলের কৃতী ছাত্রী মীরা (প্রীতি পাণিগ্রাহী)। স্কুলের নিয়মকানুন মেনে চলা, পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া, শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রী সে।
কিন্তু যতই নিষ্ঠাভরে নিয়ম মেনে চলুক না কেন, তার বয়সটা তো সেই নিয়মে আটকে থাকার নয়! তাই বেয়াড়া প্রশ্ন মাথায় খোঁচা দেয়। মেয়েরা যখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে, ছেলেরা তাদের ছবি তুললে কেন ছেলেদের শাস্তি হবে না, সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বসে দিদিমণিকে। ছেলেদের অন্যায় আচরণ ঢাকতে কেন মেয়েদেরই পোশাকের ঝুল বড় করতে হবে? এ প্রশ্ন তাকে বিচলিত করে। এ দিকে নিয়ম ভেঙেই স্কুলে আসা নতুন ছাত্র শ্রীনিবাস (কেশব বিনয় কিরণ) তার মন কাড়ে। শ্রী-র সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করার মধ্যে যে রোমাঞ্চ, তার স্বাদ চাখতেও সমান আগ্রহী মীরা।
এ পর্যন্ত একটা ধারা মেনে চলছিল ভারতীয়-ফরাসি প্রযোজনায় নির্মিত শুচি তালাতির ‘গার্লস উইল বি গার্লস’। শৈশব কাটিয়ে পরিণতির দিকে এগিয়ে চলা এক মেয়ের গল্প— ‘কামিং অফ এজ ড্রামা’ ঘরানার ছবি। কিন্তু এ ছবিতে রয়েছে মূল মা ও মেয়ের সম্পর্কের টানাপড়েন এবং এই অংশই ছবির মূল।
মীরা ও তার মা অনিলা— পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দুই প্রজন্ম দুই নারী। দু’রকম তাদের অভিজ্ঞতা। কিন্তু আসলে বছর গড়ালেও পরিবর্তন যে আসেনি, তারই দৃষ্টান্ত তারা। ছবির কাহিনি বলছে, মীরার মা-ও ওই এক স্কুলের ছাত্রী ছিল। মেয়ের পরীক্ষার সময়ে মা এসে থাকে মীরার শহরে, যাতে কোনও কারণে মীরার পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। কিন্তু অনিলার আসল ভয় অন্যত্র। মেয়ের ফলাফল খারাপ হলে, দোষ হবে মায়ের। স্বামীর কাছে হেনস্থা হওয়ার আতঙ্কেই তটস্থ অনিলা। এই ‘স্বামী’কে অবশ্য ভালবেসে বিয়ে করেছিল সে, মাত্র ২১ বছর বয়সে।
তবু, আর পাঁচজন সাধারণ স্ত্রী বা মায়ের মতো হতে চায়নি অনিলা। এ দিকে রীতিবিরুদ্ধ স্বভাবে অস্বস্তি অনুভব করে মেয়ে মীরাও। মেয়ের কাছে এসেই অনিলা ধরে ফেলে শ্রীর প্রতি মীরার আগ্রহ রয়েছে। সেই শ্রীনিবাসের সঙ্গে একরকম বন্ধুত্ব করে ফেলে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, রান্না করে খাওয়ানো— যেন আর এক বার প্রাণ খুলে বেঁচে নিতে চাইছে অনিলা। মেয়ের বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোয় তারই সঙ্গী হয়ে। এ বিষয়টা ভাল চোখে দেখে না মীরা। তার মনে হয়, তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলির মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইছে অনিলা।
অথচ, অনিলা চেয়েছিল সামান্য মনোযোগ। স্বামীর থেকে দূরে ক্লান্ত, একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সে। নিজের অজান্তেই মেয়ের মনে অশান্তি, আর আলোড়ন সৃষ্টি করে অনিলা। তৈরি হয় চাপানউতর।
শুচি তালাতি, তাঁর প্রথম ছবির গল্প বলেছেন ধীরেসুস্থে। উত্তর ভারতের শান্ত পাহাড়ি শহরটির মতো তাঁর ছবির চরিত্রগুলিও শান্ত। মনের মধ্যে তোলপাড় হলেও তার বহিঃপ্রকাশ মাপা (কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে)। উদ্ধত, তবু কিছু কিছু জায়গায় ভীতু ও খানিক দুর্বল মীরার চরিত্রে প্রীতি পাণিগ্রাহীর অভিনয় মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তাঁর অভিব্যক্তিগুলি এতটাই সাবলীল, যে বোঝাই যায় না এটা তাঁর প্রথম ছবি। অনিলার চরিত্রে কানির অভিনয় নিয়ন্ত্রিত, ও পরিণত। শ্রীর চরিত্রে কিরণও যথাযথ। জি-ই-পিং-এর ক্যামেরার কাজ ছবির নির্যাস ধরে রাখতে সক্ষম। শুচির ছবির সবচেয়ে সুন্দর বিষয় হল তার স্থিরতা। যেন একটা শান্ত অনর্গল বয়ে চলা নদী। তবে সেই স্থিরতাই কিছু দর্শকের চোখে একঘেয়ে লাগতে পারে।
মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপড়েন, কিছু কিছু দৃশ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘১৯শে এপ্রিল’ বা ‘তিতলি’র কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তবে এ ছবির গল্প অন্য। পরিচালকের উদ্দেশ্যও খানিক আলাদা। দিনের শেষে তিনি যেন এটাও মনে করিয়ে দিতে চান— ‘গার্লস উইল বি গার্লস’। তারা খোঁজে ভালবাসা ও নির্ভরতার জায়গা। অনেক চাপানউতর পেরিয়ে সেটুকু বুঝি তারা খুঁজে পায়, একে অপরের কাছেই। এক ঘণ্টা ৫৮ মিনিটের এই সফর দেখা যাচ্ছে অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়োয়।