অপর্ণা সেন। ছবি: সংগৃহীত।
সুমন ঘোষ একাধারে অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক এবং সিনেমা পরিচালক। মাঝেমধ্যে তিনি মূলত বাংলা সিনেমা পরিচালনাও করেন। জীবনের প্রথম তথ্যচিত্রটি তিনি বানিয়েছিলেন ২০১৭ সালে, নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে নিয়ে। নাম ছিল, ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’। দ্বিতীয় তথ্যচিত্রটি তিনি তৈরি করলেন বাঙালি চিত্রপরিচালক অপর্ণা সেনকে নিয়ে, কলকাতায় ঘুরে, ঘুরে, গত বছর। আনুমানিক দেড় ঘণ্টার তথ্যচিত্র মুক্তি পেয়েছে সদ্য। নাম ‘পরমা: আ জার্নি উইথ অপর্ণা সেন’।
এখানে, তথ্যচিত্র পরিচালক হিসাবে সুমনের এ পর্যন্ত কাজের ধরন বিচার করলে যে উপসংহার পাওয়া যায়, তাতে মনে হয়, তিনি তাঁর তথ্যচিত্রে এক একজন বিখ্যাত বাঙালি চরিত্রকে তুলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁর তথ্যচিত্রগুলিকে বলা যায় ‘হিউম্যান এসে’ বা মানব প্রবন্ধ। সে ভাবেই ‘পরমা: আ জার্নি উইথ অপর্ণা সেন’কে সাজিয়েছেন তিনি। ছবিটি দেখলে বোঝা যায়, একটি প্রবন্ধের মতোই ছবিটি কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা। যেগুলির নাম হতে পারে, যথাক্রমে, অভিনয়, নায়িকা হয়ে ওঠা, রোজগেরে গিন্নি, মা-বাবা ও কন্যাদের সঙ্গে সম্পর্ক, পরিচালনায় পদক্ষেপ, আশির দশকের আধুনিক বাঙালির যাপন, পত্রিকার সম্পাদক, রাজনীতি ও রাজনৈতিক বিশ্বাস। একটি বৃহৎ প্রবন্ধ যে ভাবে লেখা উচিত, ঠিক সে ভাবেই সুমন তুলেছেন ‘পরমা…’ কেবল কালি নয়, তিনি পাতা ভরিয়েছেন চলমান ছবির আঁচড়ে এবং এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রবন্ধটি তিনি বেশ ভালই রচনা করেছেন।
একটি প্রবন্ধে যেমন আশা করা উচিত, সে ভাবেই এই ছবিতে অপর্ণা সেনকে পরতে পরতে আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়েছেন সুমন। ফলে মানুষ অপর্ণা সেনের যাপনচিত্রের নানা দিক ও কারণ স্বাভাবিক ভাবেই ফুটে উঠেছে। যার অনেকটাই হয়তো তাঁর অনুরাগীদের কাছে অজানা ছিল এত দিন। যেমন, প্রথম বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে তিনি যখন তাঁর মা-বাবার সঙ্গে থাকছেন এবং যে সময়ে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে সুচিত্রা সেন পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একজন নায়িকা এবং ‘স্টাইল আইকন’ হিসাবে গড়ে তুলছেন, সে সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে বাধ্য হতে হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রে এমন সব চরিত্রে অভিনয় করতে, যা তাঁর মোটেও পছন্দ ছিল না। কিন্তু নিয়মিত রোজগারের তাগিদে তাঁকে সেই সব চরিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। তখন তিনি একজন ‘সিঙ্গল মাদার’। কন্যাকে বড় করে তোলা, মানুষ করা তো যে কোনও বাঙালির জীবনের অন্যতম বড় লক্ষ্য তখন। সময়টি মনে রাখুন, সত্তর-আশির দশক, অথবা নিজে যখন ছবি পরিচালনা করা শুরু করেছেন, সে সময় নিজের ছবির শিল্প নির্দেশনার কাজে তিনি এতটাই জড়িয়ে পড়তেন যে শুটিং শেষে যখন নিজের তৈরি ছবির সেট ভাঙা হচ্ছে, তখন তিনি ভেঙে পড়তেন, অঝোর ধারায় চোখের জল ফেলতেন। কারণ সে সময়ে তাঁর মনে হত, যে চরিত্রটিকে তিনি বহু যত্নে, ভালবেসে গড়ে তুলেছেন এত দিন ধরে, সেই চরিত্রটিকে যেন টুকরো টুকরো করে মেরে ফেলা হচ্ছে। নিজের প্রথম ছবি ‘৩৬, চৌরঙ্গী লেন’ ছবিতে এই অনুভূতিটি তাঁর ক্ষেত্রে সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠে এসেছিল। তিনি বলেই ফেলেছিলেন, “দে আর কিলিং ভায়োলেট!” এ রকম অনুভূতি তাঁর প্রথম দিকের প্রত্যেকটি ছবির ক্ষেত্রেই হত, এ কথা তিনি নিজমুখেই স্বীকার করেছেন, তথ্যচিত্রে।
‘পরমা’ তথ্যচিত্রে সুমন কেবল অপর্ণাকে নিয়ে, দ্বিতীয় জনের শুটিংয়ের জায়গাগুলিতেই আবার ফিরে যাননি, তিনি অপর্ণার সমসাময়িকদের সঙ্গে নানা আলোচনাকেও ছবিতে জায়গা দিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ও অঞ্জন দত্ত, এবং মূলত নাট্যনির্দেশক এবং অপর্ণার এযাবৎকালের প্রায় সব ক’টি ছবির অভিনেতাদের অভিনয় শিক্ষক সোহাগ সেন। এঁদের বাইরেও অপর্ণার পরিচালনায় তাঁর ছবিগুলিতে যাঁরা নানা সময়ে কাজ করেছেন, যেমন কৌশিক সেন, রাহুল বসু, সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তেরাও নানা আলোচনায় ছবিটিতে ফিরে ফিরে এসেছেন এবং অবশ্যই এসেছেন অপর্ণার দুই কন্যা কমলিনী ও কঙ্কনা। আলোচনায় এসেছেন তাঁর এই সময়ের জীবনসঙ্গী কল্যাণ রায় আর তাঁর বন্ধু শাবানা আজ়মি। তাঁদের কথায় উঁকি দিয়েছে এমন কিছু গল্প, যা কখনও কারও পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না এত দিন। যেমন শাবানা বলেছেন ‘সতী’ ছবি শুটিংয়ের সময়ে কালবৈশাখী ঝড়ের একটি দৃশ্যে পরিচালকের কথা না শুনেই শাবানা আর সে ছবির ক্যামেরাকুশলী অশোক মেহতা, কী ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুটিং করেছিলেন এবং দলের নেত্রী অপর্ণার কাছে বেদম বকুনি খেয়েছিলেন। শাবানা এই প্রসঙ্গে অপর্ণার চরিত্রের একটি অজানা দিক তুলে ধরেছেন। অপর্ণা অত্যন্ত শিক্ষিত, ভদ্র মানুষ বলে নাকি কখনও অভদ্র বা রূঢ় ভাষা ব্যবহার করতে পারেন না, ঝড়ের দৃশ্যে তিনি বকুনিও দিয়েছিলেন নম্র, ভদ্র ভাবে। কোন কোন ইংরেজি শব্দ কী ভাবে ব্যবহার করেছিলেন সে সময়, তা অনুপুঙ্খ বলেন শাবানা, যা বেশ কৌতুক উদ্রেককারী। অন্য দিকে অপর্ণা জানান, তিনি কোন অবস্থায় ইংরেজি ভাষাটি আয়ত্ত্ব করতে বাধ্য হন খুব কম বয়সে। আবার কল্যাণ জানান, কী ভাবে আমেরিকায় একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে, বাবা চিদানন্দ দাশগুপ্তের মৃত্যুসংবাদে ভেঙে পড়েন অপর্ণা। সে বর্ণনায় উঠে আসে একজন গভীর মনস্তত্ত্বের মনুষ্য রূপ। অপর্ণা পরিচালিত ‘গয়নার বাক্স’ ছবির চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদার ব্যক্ত করেন পরিচালক হিসাবে অপর্ণা কী ভাবে এমন সব অবস্থার সৃষ্টি করেন, যা অতি বড় কুশলীকেও বিপদে ফেলতে পারে। ভাল লাগে সিনেমা বিশেষজ্ঞ হিসাবে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি এবং মূল্যায়ন। কথা বলেন পত্রিকা সম্পাদক অপর্ণার সহকর্মী, অধুনা পরিচালক, সুদেষ্ণা রায়। তাঁর মূল্যায়ন বুঝিয়ে দেয় সম্পাদক হিসাবে সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে ভাবতে পারতেন অপর্ণা। একই সঙ্গে এটি দেখেও ভাল লাগে, কী ভাবে সুমন, অপর্ণার পরের দিকের ছবিগুলিতে আপন মতপ্রচারের প্রবণতাকে এড়িয়ে যাননি। ‘ঘরে বাইরে এখন’ ছবিতে দর্শক-সমালোচকদের যে অভিযোগ উঠেছিল পরিচালকের বিরুদ্ধে, তাকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ছবিতে।
অপর্ণার রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়েও যথেষ্ট দৃঢ় সমালোচনাশীল হয়েছেন সুমন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর বিষয়কেও কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছেন। এই ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ একজন উত্তম প্রাবন্ধিকের মধ্যে কাম্য। সুমন সে পরীক্ষায় বেশ ভাল ফল করেছেন।
কেবল দু’টি প্রশ্নই সুমন উহ্য রেখেছেন গোটা তথ্যচিত্রে। এক, অপর্ণা কেন প্রথম বিবাহের ফলস্বরূপ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পদবিটিকে বিসর্জন দিলেন? অপর্ণা কেন ‘সেন’ হয়েই পরিচিত হলেন, ‘দাশগুপ্ত’ কী দোষ করেছিল? তাঁর মতো একজন শিক্ষিত, স্বাধীনচেতা বাঙালি মহিলার এমন পুরনোপন্থী হওয়া বিস্ময়ের উদ্রেক করে। দ্বিতীয়, সেই একই সূত্রে গাঁথা। এতটা স্বাধীনচেতা হয়েও কেন তাঁর সারা জীবন মনে হয়েছে, নারীর একজন পুরুষসঙ্গী প্রয়োজনীয়? এই দু’টি প্রশ্নের উত্তর ছাড়া অপর্ণা সেন নামক তথাকথিত অর্ধপ্রহেলিকার সমাধান সুমন ভালই করেছেন।