Movie Review

ব্যাড নিউজ়: বিষয়ভাবনায় লুকিয়ে থাকা মৌলিকতা হারিয়ে গেল কৌতুক সৃষ্টির নিরলস প্রয়াসে

‘হেটেরোপেটার্নাল সুপারফেকান্ডেশন’—শব্দ এবং ধারণা হিসেবে এতই অচেনা যে, সেটিই মূল ভাবনা হতে পারত। কিন্তু পরিচালক বেছে নিলেন দর্শককে জোর করে হাসানোর পথ। আর গোলমালটি বাধল সেখানেই।

Advertisement
অতীন্দ্র দানিয়াড়ী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৪ ১৪:০২
Image of  Vicky Kaushal, Tripti Dimri and Ammy Virk

‘ব্যাড নিউজ়’ ছবিতে ভিকি কৌশল, তৃপ্তি ডিমরি ও অ্যামি ভির্ক। ছবি: সংগৃহীত।

রাস্তার ধারে, দালানে কয়েকটি ছেলে বসে আড্ডা মারছে। এক ভদ্রলোক রাস্তায় পড়ে থাকা একটা কলার খোসায় পিছলে পড়ে গেলেন। দালানে বসা ছেলেরা হো হো করে হেসে উঠল। ছেলেদের কাছে ভদ্রলোকের পড়ে যাওয়ার ঘটনাটা কমেডি হলেও, ভদ্রলোকের কাছে ঘটনাটা কিন্তু ট্র্যাজেডি। কমেডি কী? সেটা বোঝাতে গিয়ে উৎপল দত্ত এমন উদাহরণ ব্যবহার করতেন। তিনি বলতেন, কেউ যদি মনে করেন অভিনয় করে দর্শককে হাসাবেন, তাহলে সেটা ভাঁড়ামি হতে বাধ্য। ঘটনার বৈচিত্রকে অনুভব করে চরিত্রের মধ্যে ট্রাজেডিকে সময় মতো, সঠিক ভাবে ব্যক্ত করাই একজন প্রকৃত কৌতুকাভিনেতার কাজ। ট্রাজেডি ও কমেডির সঠিক ভারসাম্যের উপর একটি হাসির ছবির সাফল্য নির্ভর করে, কারণ প্রতিটি হাসির ঘটনার পিছনে লুকিয়ে থাকে কোনও এক জন বা অনেকের যন্ত্রণা এবং অনিশ্চয়তা। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, আনন্দ তিওয়ারি পরিচালিত ‘ব্যাড নিউজ়’ ছবিটি দর্শকের কাছে প্রকৃতপক্ষেই ‘খারাপ খবর’ হয়ে উঠতে পারে। একটি হাসির ছবি তৈরি করার ভাবনা নিয়েই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে, ফলে শুরু থেকে সবাই অক্লান্ত ভাবে দর্শককে হাসানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি। তাই নিটোল একটি গল্প গড়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র অভিনেতারাই নন, উচ্চগ্রামের আবহসঙ্গীত, মজার শব্দ, অযৌক্তিক ঘটনাপ্রবাহ এবং দুর্বল চিত্রনাট্য— সবই দর্শককে যেন কাতুকুতু দিয়ে হাসাবার চেষ্টা করেছে, যেটা দর্শকের কাছে হয়তো ট্রাজেডি হয়ে উঠতে পারে।

Advertisement
Image of Vicky Kaushal Tripti Dimri

ছবির একটি দৃশ্যে ভিকি কৌশল ও তৃপ্তি ডিমরি। ছবি: সংগৃহীত।

ছবি শুরু হয় অখিল চাড্ডা (ভিকি কৌশল) ও সলোনির (তৃপ্তি ডিমরি) প্রেমের গল্পে। দু’জনের প্রেম, ঘুরে বেড়ানো, খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে গল্প যত ক্ষণে বিয়েতে পৌঁছয়, তত ক্ষণে মূল্যবান পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে। অথচ, অখিল ও সলোনির বিয়েতেই এই কাহিনির চমকপ্রদ অধ্যায় বা গল্পের মূল শিকড় লুকিয়ে রয়েছে। এটি খুবই আকর্ষণীয় এবং অভিনব। ‘হেটেরোপেটার্নাল সুপারফেকান্ডেশন’ শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। এর সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘যৌথ পিতৃত্বে অলীক গর্ভধারণ’। ছবিটি এমনই আনকোরা একটি ভাবনা থেকে তৈরি হয়েছে। অখিল-সলোনির বিয়ের পর তাদের মধ্যে ছোটখাটো মনোমালিন্য তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। একদিন অশান্তি চরমে পৌঁছলে সলোনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সময় গুরপ্রীত পান্নুর (অ্যামি ভির্ক) সঙ্গে সলোনির পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক রাগ-অনুরাগ পেরিয়ে সলোনি আবার অখিলের কাছে ফিরে আসে, সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। সলোনির সন্তানসম্ভবা হওয়ার খবরে অখিল খুব আনন্দ পায়। কিন্তু সলোনি তাকে পিতৃত্বের পরীক্ষা দিতে বলে। সলোনি নিশ্চিত হতে চায়, এই সন্তান আসলে কার? অখিলের, না কি গুরপ্রীতের? ছবির মূল গল্পের শুরু এখান থেকেই। পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা দেখেন, সলোনি যমজ সন্তানের মা হতে চলেছে। একটি ভ্রূণের পিতা গুরপ্রীত এবং অন্যটির অখিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে এমন ঘটনা সারা পৃথিবীতেই বিরল।

কী হবে এর পর? দুই সন্তানের দুই পিতা কি এই অলীক পিতৃত্বকে মেনে নেবে? না কি তৈরি হবে নতুন কাহিনি? এই প্রশ্নগুলির উত্তরের জন্যই ছবিটি দেখা যেতে পারে। এমন অভিনব ভাবনা নিয়ে এর আগে কোনও ভারতীয় চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। এমন অলীক এবং বিরল ভাবনার জন্যই ছবিটি অনায়াসে দর্শকদের কাছে একটা বিশেষ জায়গা তৈরি করতে পারত, যদি পরিচালক সস্তার মনোরঞ্জনের সহজ পথে না হেঁটে একটি যুক্তিপূর্ণ নিটোল গল্প বলার চেষ্টা করতেন।

মনে রাখতে হবে, এমন ভাবনার সঙ্গে কিন্তু আমাদের সমাজ পরিচিত নয়। ফলে এই ভাবনার জন্য চরিত্রগুলিকে তাদের পরিবেশ অনুযায়ী বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দরকার ছিল। মধ্যবিত্ত ঘরের অখিল বা বনেদি পঞ্জাবি পরিবারের গুরপ্রীতের ‘যৌথ পিতৃত্ব’ মেনে নেওয়ার মধ্যে পর্যাপ্ত যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। সলোনির ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ ও মানবিক চরিত্রের সঙ্গে গুরপ্রীতকে নিয়ে একটা রাত কাটানো বেশ অযৌক্তিক বলে মনে হয়। পিতৃত্বের জন্য অখিল ও গুরপ্রীতের বদলে যাওয়া, অনেক কিছু মেনে নেওয়া এবং সলোনির কথা মেনে চলার মধ্যে গল্পের ছেলেমানুষিই প্রমাণিত হয়। ছবিতে বেশ কিছু দৃশ্য, যেমন অখিলের ফোন জলে পড়ে যাওয়া, গুরপ্রীতের লুকিয়ে চিকেন খাওয়া, অখিল ও গুরপ্রীতকে চিকিৎসকের বোঝানো বা বাচ্চা হওয়ার পর গুরপ্রীত ও অখিলের অভিব্যক্তি দেখতে ভাল লাগে। ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফি এবং আলোর কাজ প্রশংসার দাবি রাখে। সলোনির চরিত্রে তৃপ্তি ডিমরির অভিনয় বেশ পরিণত। ভিকি কৌশল চরিত্র অনুযায়ী ভাল কাজ করলেও, বেশ কিছু জায়গায় অতি অভিনয়ের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। এ ছাড়া অ্যামি ভির্ক এবং নেহা ধুপিয়া চরিত্র অনুযায়ী যথাযথ।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

তবে শেষ পর্যন্ত একটা আক্ষেপ থেকে যায়। করণ জোহর প্রযোজিত অভিনব বিষয়ভাবনার ছবি ‘ব্যাড নিউজ়’, কাহিনি নির্মাণ ও চিত্রনাট্যের দুর্বলতায়, প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, জাভেদ আখতারের মতো গীতিকার, অনু মালিকের মতো সঙ্গীত পরিচালক এবং সুদক্ষ কলাকুশলীদের নিয়েও সস্তা মনোরঞ্জনের গলিপথে হারিয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement