সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।
সকাল থেকে দম ফেলতে পারছি না। ফোনের পর ফোন আছড়ে পড়ছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। মানুষটি ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাকেই তাই যেন গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো সারতে হচ্ছে! নানা জনের নানা প্রশ্ন। উত্তর দিতে দিতে হয়তো হাঁপিয়েও যাচ্ছি। ক্লান্তি আসছে কি? একেবারেই না। বরং, বাবা যেন আরও বেশি করে আমায় জড়িয়ে ধরছেন! নিজে উপস্থিত না থেকেও।
বাবা নেই এক বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তার পরে একটা করে দিন সংখ্যায় বেড়েছে। ৩৬৬, ৬৭, ৬৮...। আমি ছাপোষা, তাই বাবার অভাব যেন বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে আমায়। আপনাদের কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নন। আমার ঘরোয়া বাবা। যিনি বাজারেও যেতেন, মুদির দোকানেও। মুদির দোকান থেকে ফেরার পরে ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঠোঙা হাতে তুলে নিতেন। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলোর তলার মেলে ধরতেন সেই কাগজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন! অন্য অনেক বাবা যেমন করেন। এই হলেন আমার বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যিনি স্কুলের পরীক্ষার খাতায় অকাতরে সই দিয়েছেন! আমারও মনে হয়নি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্বাক্ষর করছেন, তাঁরও না! তিনি তো সন্তানের পিতা হিসেবে খাতা সই করছেন। এই জায়গা থেকেই নিয়মিত স্কুলে পৌঁছে দিতেন আমায়। স্কুল থেকে আনতে যেতেন। আমার নাচের স্কুলেও তাঁর নিত্য যাতায়াত ছিল। আমায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ওঁর।
অনেকেই অবাক প্রশ্ন করেছেন, স্কুলের চারপাশে ভিড় হত না? সত্যিই বলছি, হত না! কারণ, তখন সময়টাই অন্য রকম ছিল। দূর থেকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন অনুরাগীরা। যে যার কাজে চলে যেতেন তার পর। এত উন্মাদনাই ছিল না! আমার বাবাও এই তারকাসুলভ ইমেজে নিজেকে বন্দি করতে একেবারেই ভালবাসতেন না। এমনও হয়েছে, বাইরে বাবাকে নিয়ে মাতামাতি। কোনও ছবি-মুক্তির পরে বা নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পরে তাঁকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রশংসার ঢল। আমার বাবা জোড় হাতে ঘরের মধ্যেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, ‘‘আমি কি আদৌ এত কিছু পাওয়ার যোগ্য? এত ভালবাসা, উন্মাদনা, সম্মান যে সবাই দিচ্ছেন, আমার কাজ মানুষের কতটা উপকারে লাগছে? আমি তো মাদার টেরেসার মতো বস্তিতে গিয়ে নরনারায়ণের সেবা করতে পারছি না! তা হলে?’’ আমাদের খুব সাদামাঠা বাবা বলতেন, কেউ পেশায় চিকিৎসক হন। কেউ ইঞ্জিনিয়ার। তেমনই তিনি অভিনেতা। এর বেশি কিচ্ছু নন।
বাবা আমাদের কখনও বিদেশ দেখাতে নিয়ে যাননি! বাবা সাঁওতাল পরগণা দেখিয়েছেন। রাঙা মাটির দেশ দেখিয়েছেন। দেশের আনাচে কানাচে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘‘নিজের দেশকেই ভাল করে চিনতে, জানতে পারলাম না! বিদেশ যাব কী? দেশকে আগে ভাল করে দেখি। তার পর না হয় বিদেশের কথা ভাবব।’’ ওই জন্য আমার বা আমার দাদার মনে বিদেশ নিয়ে কোনও মোহ নেই। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প বোধের পাশাপাশি আরও একটি জিনিস উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। সেটা স্বাধীনতা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। নিজের, অন্যদেরও। ফলে, আমাদের উপরে কোনও কিছু চাপিয়ে দেননি। আমরা যা, যেটুকু সবটাই নিজেদের ইচ্ছেয়। এমনকি গায়েও হাত তোলেননি কোনও দিন! বাবা গম্ভীর মানেই আমরা কিছু ভুল করেছি। বুঝে যেতাম ভাই-বোনে। তখন থেকে শুরু হত আত্মবিশ্লেষণ। নিজেদের ভুল নিজেরা খুঁজে বের করতাম। নিজেরাই সংশোধন করতাম।
শেষের দিকে বাবা দেশজুড়ে এই স্বাধীনতার অভাব দেখে খুব ক্ষুণ্ণ হতেন। কে কী পরবেন, কী খাবেন, কোথায় যাবেন বা যাবেন না, কোন ধর্মে বিশ্বাসী হবেন! সবেতেই মাতব্বরি তাঁকে আহত করত। বাবা হয়তো সর্বসমক্ষে সে ভাবে বলেননি। আমাদের সঙ্গে যখনই কথা হত বলতেন, ‘‘মানুষের নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছেও যদি পরের বশীভূত হয় তা হলে আর স্বাধীনতা, পরধর্মসহিষ্ণুতার রইল কী?’’ তার পরেই মাথা নেড়ে বিষণ্ণ গলায় বলতেন, ‘‘এ দেশ আমার চেনা দেশ নয়!’’