ছবি মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনালাইনের সঙ্গে গুছিয়ে আড্ডা দিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ইনস্টাগ্রাম
কখনও কলকাতা, কখনও মুম্বই! তারই ফাঁকে দেশের আরও নানা জায়গায় ঝটিতি সফর। টলিউডে এই মুহূর্তের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা। মুম্বইয়ে একের পর এক কাজ নিয়ে তাঁর প্রশংসা যেমন শোনা যায়, তেমনই কান পাতলেই শোনা যায় তাঁকে ঘিরে একগুচ্ছ নালিশও। ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাচ্ছে তাঁর পরিচালিত ‘বৌদি ক্যান্টিন’। ছবি মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে গুছিয়ে আড্ডা দিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: প্রচলিত ধারণা, পরমব্রতর ছবি মানেই বজ্রকঠিন কোনও বিষয়। সেই ধারণা ভাঙতেই কি বার বার ‘বৌদি ক্যান্টিন’কে সহজ ছবি বলছেন?
পরমব্রত: আমি কি কোনও দিনও কঠিন কোনও ছবি বানিয়েছি, বলুন তো! আমার পরিচালনায় যে ক’টি ছবি হয়েছে, ‘অভিযান’ ছাড়া আরও কোনও ছবিই কি সে ভাবে কঠিন ছিল? ‘অভিযান’-এর বিষয়ই এমন ছিল যে, ওটা নিয়ে একটু গভীরে গিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু ‘সোনার পাহাড়’ বা ‘বনি’— কোনওটাই কি কঠিন? ‘হাওয়াবদল’ তো ছেড়েই দিলাম। ওর মতো ফুরফুরে ছবি খুব কম হয়। যে হেতু একটু গুছিয়ে কথা বলি, নিজস্ব মতামত আছে, যা ব্যক্ত করতে পছন্দ করি, যে কোনও বিষয় একটু তলিয়ে দেখতে ভালবাসি, তাই বোধহয় ‘আঁতেল’ ট্যাগটা লেগে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও একটা জিনিস কিন্তু লক্ষণীয়, আমার মতো কাউকে যদি ইন্টালেকচুয়াল বলা হয়, তার মানে আমরা আমাদের ইন্টালেকচুয়ালিজমের মাপকাঠি কতটা নামিয়ে এনেছি! আমার তো এই শিরোপা পাওয়ার কোনও রকম যোগ্যতাই নেই! ছোট থেকে ধরণী ঘোষ-শঙ্খ ঘোষদের মতো মানুষদের ইন্টালেকচুয়াল বলে জেনে এসেছি। আমি যদি ইন্টালেকচুয়াল হই, তা হলে তো আমরা আমাদের বিদ্যেবুদ্ধির মাপকাঠি একদম গোড়ালিতে এনে ঠেকিয়েছি। আমার কথাগুলো শুনলে হাসিও পায়, আবার দুশ্চিন্তাও হয়।
প্রশ্ন: একই দুশ্চিন্তা আপনার বাংলার কনটেন্টের ক্ষেত্রে হয় না? অনেক মধ্যমানের ছবি বা ওয়েব সিরিজ়ও যেন বড্ড বেশি প্রশংসিত হচ্ছে বলে মনে হয়নি?
পরমব্রত: (চোখ কপালে তুলে) সেই আলোচনায় আর ঢুকতে চাই না! মধ্যমেধার উদ্যাপন আমরা যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছি, সেটা অভাবনীয়! কাজের ক্ষেত্রেও আমরা যেগুলোকে ‘বাহ্-বাহ্’ করছি, সেগুলো যে আসলে কতটা সাধারণ কাজ, সেটা আমরা বুঝতে পারি না। হয়তো সে কারণেই আগের মতো আমাদের কাজগুলো আর বহির্বিশ্বে সে ভাবে সমাদৃত হচ্ছে না। কারণ আমরা খুব অল্পতে সন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছি। তবে সবার আগে সমস্যাটা স্বীকার করতে হবে। তা হলেই নিজেকে নিজেদের চ্যালেঞ্জ করতে পারব। আমরা যে শৈল্পিক ভাবে বা অর্থনৈতিক ভাবে ভাল অবস্থায় নেই, সেটা তো মানতে হবে। নিজেদের বুদবুদে বাস করলে বিপদ।
প্রশ্ন: প্রযোজক হিসাবে যখন ছবি বাছেন, তখন শৈল্পিক আর অর্থনৈতিক দিকের মধ্যে কোনটার পাল্লা বেশি ভারী রাখেন?
পরমব্রত: আমি কিন্তু এমন গল্প কখনওই বাছি না যা সকলের ভাল লাগবে। ধরুন, অনেক কোম্পানিই তো শ্যাম্পু বানায়। প্রত্যেকেই কিন্তু বাজারে তাদের ক্রেতা ঠিক কোন দলের মানুষ, সে কথা মাথায় রেখেই শ্যাম্পু তৈরি করে। সেই মতো উপকরণ ব্যবহার করে এবং সেই অনুযায়ী শ্যাম্পুর দাম ঠিক করে। আমিও যখন ছবি বানাই, এক অংশ দর্শকের কথা মাথায় রেখেই বানাই। আর সেই দর্শকের মনের কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য যা যা প্রয়োজন, সেই উপাদানগুলো অবশ্যই মজুত রাখার চেষ্টা করি। তবে পুরোটাই তো একটা বাজি ফেলার মতো! কারও কাছে কোনও ছকে বসানো ফর্মুলা নেই। বিভিন্ন জিনিস চেষ্টা করে দেখা আর কী!
প্রশ্ন: ছবিটা যতটা সহজ বলছেন, ততটা সহজ কি?
পরমব্রত: আমি মনে করি কঠিন কথা সহজ ভাবে না বলতে পারলে তার কোনও মানেই থাকে না। নারী ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য, ‘জেন্ডার রোল’-এর মতো শব্দগুলো কিন্তু আমাদের রোজকার জীবনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে হয় বলে এই শব্দগুলো তৈরি হয়েছে। যে হেতু গল্পটা সাধারণ মানুষের জীবন থেকে উঠে আসা, তাই বার বার ছবিটাকে সহজ ছবি বলছি।
প্রশ্ন: কলকাতা-মুম্বইয়ে মিলিয়ে জমিয়ে কাজ করছেন। প্রযোজনা, পরিচালনা আর অভিনয়ের মধ্যে গুরুত্ব কোনটা বেশি পাচ্ছে?
পরমব্রত: অভিনয়টাই বেশি গুরুত্ব পায়। কারণ অভিনয় করে আমার যে পরিচিতি তৈরি হয়েছে, বাংলাতে তো ছিল, কিন্তু মুম্বইয়েও যেটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে, তা আমার একটা নিরাপদ জায়গা দিতে পেরেছে। ২১ বছর ধরে অভিনয় করছি। অ্যাক্টিং হ্যাজ বিকাম লাইক মাই সেকেন্ড স্কিন! এটা ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আর ছোট থেকেই পরিচালনা করতে চেয়েছিলাম। এটা নিয়ে পড়াশোনা করেছি। এটাই আমার প্যাশন এবং সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গা। দু’টোর সহাবস্থানটা আমায় বজায় রেখেই চলতে হয়। মাঝেমাঝে বেশ চাপ হয়। কিন্তু ভাল লাগে বলেই বোধহয় করতে পারি।
প্রশ্ন: আপনার ঝুলিতে তো অনেক গল্পই জমা থাকে। পুজোর সময় কোন ছবিটা মুক্তি পেলে বেশি লাভবান হবেন, বোঝেন কী করে?
পরমব্রত: কোনও ছবি যখন বানাই, তখন কিন্তু মাথায় কোনও নির্দিষ্ট মুক্তির সময় থাকে না। কেউ কেউ অবশ্য বিশেষ অনুষ্ঠান ভেবেই ছবি তৈরি করেন। দেব যেমন পুজো বা ইদের কথা মাথায় রেখে ছবি করে, শিবুদাও (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) করেন, এমনকি, এসভিএফ-ও সে ভাবেই প্রত্যেকটা ছবির পরিকল্পনা করে। আমার সব ছবি ও ভাবে হয় না। কিছু কিছু হয়। আমার পরিচালিত একটা ছবি যেমন আমি জানি, আগামী বছরের শুরুর দিকে মুক্তি পাবে। কিন্তু ‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর ক্ষেত্রে তেমন কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তবে পুজোর সময় দর্শক একটু বেশি হলে গিয়ে ছবি দেখেন। গত ১০-১২ বছর এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সেটা আমাদের জন্য অবশ্যই আনন্দের। কারণ অন্য সময় সে ভাবে দর্শক বাংলা ছবি হলে গিয়ে দেখেন না। আমার যখন শ্যুটিং চলছে, তখনই জানতাম যে ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ আর ‘কাছের মানুষ’ পুজোয় মুক্তি পাবে। সব জেনেই কিন্তু আমরা ‘বৌদি ক্যান্টিন’ পুজোয় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তার মূল কারণ, বাকি দু’টো ছবির তুলনায় এটা একদম অন্য রকম একটা ছবি। একটা সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির তৃতীয় ছবি আর অন্যটা একদমই অন্য ধাঁচের একটা ছবি। সেখানে আমাদের ছবিটা একটা মিষ্টি জীবনের গল্প যার সঙ্গে সাধারণ মানুষ নিজেদের মেলাতে পারবেন।
প্রশ্ন: অন্য ছবিগুলো কেমন তা জেনেও একসঙ্গে রিলিজ় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মানে এই ছবি নিয়ে আপনি বেশ আত্মবিশ্বাসী?
পরমব্রত: আমি কখনও কোনও জিনিস নিয়ে বোকার মতো আত্মবিশ্বাস জাহির করি না। যখন কোনও ছবিতে অভিনয় করি বা কোনও ছবি বানাই, আমার যেটুকু বিদ্যাবুদ্ধি আছে সেটা প্রয়োগ করে, নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা রেখে, অত্যন্ত যত্ন নিয়ে কাজটা করার চেষ্টা করি। সেখান থেকে বলতে পারি ‘বৌদি ক্যান্টিন’ খুব সুন্দর করে কিউরেট করা একটা ডিশ বলা যেতে পারে। যার স্বাদ বা আফটারটেস্ট মানুষের মনে লেগে থাকবে। তবে আমি ওভার কনফিড্যান্ট নই, সেটা হলে সর্বনাশ হবে।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে তো কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, অহংকারে পরমের পা আর মাটিতে পড়ে না...।
পরমব্রত: ও তাই (অবাক হয়ে...)! ওই আমি একটু কথা বলি বলে বোধ হয় লোকে এমন ভাবে। আসলে আমাদের সমস্যটা হচ্ছে যে, আমরা নিজেদের বুদবুদে থাকতে খুব ভালবাসি। না আমরা মুক্তমনে কারও সমালোচনা করি, না মেনে নিতে পারি। এই দু’টোই যদি আমরা না করতে পারি, তা হলে কিন্তু আমরা আমাদের সঙ্কটগুলো বুঝতে পারব না। আর সেটা না বুঝলে তো আর উন্নতি করতে পারব না। ৪১ বছর বয়সে তো নিজের স্বভাব পরিবর্তন করতে পারব না, আর তেমন ইচ্ছেও নেই! আমার যখন যা মনে হয়, পরিষ্কার করেই বলি। যে কারণে আমার নামে এগুলো বলা হচ্ছে, আমি কিন্তু সেই কথাগুলো আমার কাছের কিছু মানুষের বিশেষ আচরণ দেখেই বলেছিলাম। যেগুলো দেখে আমার মনে হয়েছিল যে, আমাদের আরও একটু মাটিতে পা রাখা দরকার! এই মুহূর্তে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির যা অবস্থা, তাতে আমরা বোধহয় একটু বেশিই আলগা দিচ্ছি। সিনেমা বানানোয় মন না দিয়ে অন্য দিকে বেশি মন যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি বেশি করে মাটি কামড়ে চলাতে। আজ অবধি আমার কোনও পার্সোনাল এন্তোরাজ নেই। আমি এখনও খুব সাধারণ ভাবে যে কোনও রাস্তায় হেঁটে যেতে পারি, যে কোনও দোকানে ঢুকে যেতে পারি, গাড়ি থামিয়ে নিজে মুখ বাড়িয়ে চা খাই, নিজের পেট্রোল নিজে নিই। আমার সব কাজই আমি নিজে করি। এগুলো যদি মাটিতে পা রেখে চলা না হয়, তা হলে আর কী ভাবে চললে মাটিতে পা থাকবে, তা আমার জানা নেই।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে একটু বেশি সাফল্য পেয়ে গেলে কি এখানে এই ধরনের কথা বেশি ওঠে?
পরমব্রত: আমি কি মুম্বইয়ে সত্যিই সফল? এক বার ওখানে গেলে বিষয়গুলো বোঝা যায়। ওখানে তো আমি একটা পেশাদার পরিসরে কাজ করি, তাই আমার রিয়্যালিটি চেকটা খুব কড়া ভাবে হয়। আমি জানি, আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। কতটা সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি, কতটা পারিনি, কতটা পারব ভবিষ্যতে আর কতটা কোনও দিনও পারব না, সেটা কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার। কিন্তু মুম্বইয়ে ক্রমাগত কাজ করলে চেনাজানার পরিসরটা অনেকটা বাড়ে। তাতে বেশ কিছু বিষয়ে চোখ খুলে যায়। সেই জন্য হয়তো কিছু কথা একটু জোর দিয়ে বলতে পারি। মানুষ তো মতামত তৈরি করে অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। গত কয়েক বছরে আমার অভিজ্ঞতাটা বেড়েছে, তাই কথাও হয়তো বেশি বলছি।
প্রশ্ন: আপনি কিন্তু চিরকালই স্পষ্টবক্তাই ছিলেন...।
পরমব্রত: (জোর দিয়ে...) চিরকালই ছিলাম। এখন হয়তো আরও একটু গুছিয়ে কথা বলি। আগে একটু এলোমেলো ভাবে বলতাম। সেটা অবশ্য বয়সের জন্যেও হয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেক হীনম্মন্যতা কমতে থাকে। মানুষ বুঝতে শেখে যে জীবন একটাই।