আধুনিক সিনেমাকে স্তব্ধ করে চলে গেলেন পরিচালক জঁ লুক গোদার।
‘আগে ব্যাকরণ শেখো, তবে তো ভাঙবে’! নাহ্, এই নিয়ম মানার কোনও দিনও ধার ধারেননি জঁ লুক গোদার। যে সময়ে হলিউড কিছু তাবড় প্রযোজনা সংস্থার ভারে নুইয়ে পড়ছে, সেই সময়ে তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফ্রান্সের এক নতুন পরিচালক ঝড় তুলেছিলেন সিনেমা জগতে। স্টুডিয়ো সিস্টেমের বাইরে গুটি কয়েক মানুষ নিয়ে, হাতে ধরা ছোট ক্যামেরা, এলোমেলো সংলাপ আর দর্শককে ধাক্কা দেওয়া সম্পাদনার কায়দায় যে কেউ আস্ত ছবি বানিয়ে ফেলতে পারেন, তা কেউ তখন কল্পনাও করেননি।
মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শহুরে বাঙালি মানেই সত্যজিৎ রায়ের পাশাপাশি সকলেই অল্প-বিস্তর গোদারের নাম শুনেছেন। প্রথমে বানান দেখে ভেবেছেন, ‘জিন লুক গোডার্ড’ বোধহয়! তার পর খানিক পার্ক স্ট্রিট, খানিক নন্দন চত্বর ঘুরে তাঁরা শিখেছেন, নামটা আদপে জঁ লুক গোদার। জিভ কায়দা করে ঘুরিয়ে তার উচ্চারণ করতে হয়। আর যাঁরা একটু উৎসাহী, তাঁরা পড়াশোনা করে জেনেছেন, গোদার ষাটের দশকের এক গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি পরিচালক। কী সব সাদা-কালো ছবি বানিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন যেন! গোটা পৃথিবী জুড়ে তাঁকে বেশ মান্যিগণ্যি করা হয়। অ্যালফ্রেড হিচকক, জঁ লুক গোদার, সত্যজিৎ রায় এবং আকিরা কুরোসাওয়ার নাম যে এক নিশ্বাসে নিতে হবে, তা শিখে গিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু তার বেশি কত জন জানেন?
কে এই গোদার? ৯১ বছর বয়সে এক বুড়ো ফরাসি পরিচালক প্রয়াত হওয়ায় কেন সিনেমা জগতে ‘গেল গেল’ রব উঠছে? কত জন দেখতেন তাঁর ছবি? ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে জঁ লুক গোদারের কি আদৌ কোনও মাহাত্ম্য রয়েছে? অনেকেরই হয়তো এই উত্তরগুলো জানা নেই। কারণ গোদারের ‘ব্রেথলেস’ ছবির বাইরে হয়তো তাঁরা কোনও দিন কোনও ছবি দেখেননি। দেখলেও বুঝতে পারেননি, কেন সকলে এই পরিচালককে জিনিয়াস বলতেন। গোদারের ছবি বুঝতে এতই সময় লাগে যে, অনেকে উৎসাহ হারিয়ে আর দ্বিতীয় কোনও ছবি দেখার ইচ্ছাপ্রকাশ করেননি। অবশ্য তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে আধুনিক সিনেমা, যার খানিকটা এখনও আমরা বড় পর্দায় দেখি, তার পথপ্রদর্শকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গোদার।
১৯৩০ সালে প্যারিসে জন্ম গোদারের। কম বয়স থেকেই ‘কাইহুর দু সিনেমা’ পত্রিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক আন্দ্রে বাজাঁর ভক্ত ছিলেন গোদার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও মন টেকেনি তাঁর। এক দল সিনেমাপ্রেমী জুটিয়ে দল বানিয়ে নিয়েছিলেন। নানা তর্ক-বিতর্ক-দর্শন চলত। তবে ১৯৬০ সালে ‘ব্রেথলেস’ ছবিটা বানিয়ে যেন সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আগে সিনেমা মানেই সকলে বুঝতেন হলিউড। হলিউড মানেই ‘এমজিএম’, ‘ফক্স’, ‘প্যারামাউন্ট’-এর মতো হাতেগোনা কিছু তাবড় প্রযোজনা সংস্থা। আপনি অভিনয় করুন, চিত্রনাট্য লিখুন, ক্যামেরার কাজ করুন, সম্পাদনা করুন বা স্পটবয় হোন, এই গুটিকয়েক প্রযোজনা সংস্থার বাইরে আপনি কাজ করতে পারবেন না। তারাই বলে দেবে, কী ভাবে কোন দৃশ্যের শ্যুটিং হবে, কোন গল্প পর্দায় কী ভাবে বলতে হবে, কোন দৃশ্যে সংলাপের সঙ্গে কেমন আবহসঙ্গীত বাজবে, কারা কাজ করবেন, কারা করবেন না— শুরু থেকে শেষ সবই ছিল এই স্টুডিয়ো সিস্টেমে আবদ্ধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে আমূল পরিবর্তন এল। সিনেমা নিয়েও অন্য ভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। সেই মুহূর্তেই আধুনিকতার জন্ম এবং প্রসার। তখনই সব কিছু যেন থমকে গেল ‘ব্রেথলেস’ দেখে। একটা ছবিতে সংলাপ এলোমেলো, কত কী শোনাই যাচ্ছে না, চরিত্রগুলো কী করছে বোঝার উপায় নেই, যেন ইচ্ছাকৃত ভুল ভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে। দর্শক যখন বিভ্রান্ত, তখন গোদারের ছবি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে। বাস্তবে আপনি কি সত্যিই একটি ভিড় ক্যাফেতে বসা সকলের সংলাপ শুনতে পান, আপনি কি বুঝতে পারেন হঠাৎ পথে দুর্ঘটনা হলে তার পর আহতদের কী হয়? হলিউড যে গল্প ‘বাস্তবের কাছাকাছি’ বলে এত দিন চালিয়ে যাচ্ছে, তা যে সম্পূর্ণ ভাঁওতা, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গোদার।
গোদার ছবি করতেন হাতেগোনা লোক নিয়ে, পথেঘাটে। বিশাল স্টুডিয়োর চমক, এলাহি আয়োজন প্রয়োজন পড়েনি। তাই ছোট ক্যামেরা হাতে ধরেই দিব্যি কাজ চলে গিয়েছে। কম বাজেটে দিব্যি তৈরি হয়েছে একেকটা ছবি। এখন যে পাশের বাড়ির ছেলে হাতে মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে ইউটিউব চ্যানেল চালায়, সেই সাহস কয়েক দশক আগে জুটিয়েছিলেন গোদার। শুধু তা-ই নয়। নব্বইয়ের দশকে যারা এমটিভি-র নানা রকম মিউজিক ভিডিয়ো দেখে বড় হয়েছে, সেই ধরনের চিত্রগ্রহণও সম্ভব হত না যদি না গোদার ‘জাম্প কাট’ কায়দায় সম্পাদনা শেখাতেন! হলিউডের একাধিক ব্যাকরণ ভেঙে নতুন নিয়মকানুন তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর এবং আরও কিছু ফরাসি পরিচালকের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল ফরাসি নব্যধারার সিনেমা।
গোদারের সিনেমা বোঝা সত্যিই সহজ নয়। আবার খুব কঠিনও নয়। তিনি সিনেমার উদ্যাপন করতেন না। বরং বার বার বলতেন, সিনেমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। ১৯৬৭ সালের ছবি ‘উইকএন্ড’-এর শেষে পর্দায় ভেসে ওঠে ‘এন্ড অব দ্য স্টোরি, এন্ড অব সিনেমা’! তিনি শব্দ আর ছবিকে কোনও ভাবে পর্দার বাইরে স্বাধীন করে দিতে চাইতেন। তবে ফরাসি নব্যধারার আরও অনেক পরিচালকের ছবির চেয়ে তাঁর ছবি কিছুটা অন্য রকম ছিলও বটে। ‘পিয়েরে লে ফু’ দেখে বেশির ভাগ লোকেরই মনে হতে পারে, ‘এ কী উন্মাদনা’! কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সে এক প্রেমের গল্প মাত্র। প্রেম তো এমনই হয়— সংজ্ঞাহীন, খামখেয়ালি! অনেকে হয়তো জানেন না, কিন্তু শাহরুখ খান-মনীষা কৈরালার ‘দিল সে’ অনেকটা এই ছবির আধারেই তৈরি!
এ কথা সত্যি যে, গোদারের ছবি বুঝতে বড্ড পরিশ্রম করতে হয়। পর্দায় একটা গল্প দেখতে যান দর্শক। বিনোদনই আসল। এত মাথা খাটাব কেন? গোদারের ছবি নিয়ে এই অভিযোগই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। কিন্তু গোদার যে শুরু থেকে মার্ক্সীয় চিন্তাধারায় ছবি বানান! বিনোদন জোগানোর জন্য নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদের ফন্দি সিনেমা দেখিয়ে বাস্তব ভুলিয়ে রাখা। গোদার তেমন সিনেমা বানাতে চাইতেন না। তিনি চাইতেন, দর্শক পর্দায় এমন ছবি দেখুন, যা দেখে তাঁরা ভুলে যাবেন না যে, সেটা আলো-আঁধারির ভেল্কি মাত্র।
অনেক সিনেমাপ্রেমী বাঙালি অবশ্য গোদারের এই সব যাবতীয় অবদান গুলে খেয়েছেন। সব ছবি দেখেছেন, বুঝেছেন, শিখেছেন। কিন্তু ভালবেসেছেন কত জন? সেই সংখ্যাটা আরও হাতে গোনা। সেই দলে যাঁরা পড়েন, তাঁরা ‘ম্যাসকুলিন ফেমিনিন’-এর কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারবেন না। এমন সহজ-সরল আধুনিক ছবি খুব কম হয়। কোনও গল্প নেই, অথচ আছে অনেক কিছু। এই ছবিই আমাদের উপহার দিয়েছে ‘চিলড্রেন অব মার্ক্স অ্যান্ড কোকা কোলা’র মতো অনবদ্য সংলাপ। চারপাশে তাকালে বোঝা যায় বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালি এখনও কিন্তু তা-ই। আর এখানেই বোঝা যায় গোদারের মাহাত্ম্য।
২০১৮ সাল পর্যন্তও তিনি ছবি বানিয়ে গিয়েছেন। আধুনিক সিনেমার স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে সিনেমা এখন পৌঁছে গিয়েছে অনেক দূর। সিজিআই-ওটিটির জমানায় গল্প বলার নতুন ভাষার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছিলেন গোদার। তবে আপস করছিলেন না। বাণিজ্যিক ছবি বানিয়ে টাকা কামানোর ফাঁদে কখনও পা দেননি। কোনও দিনও গল্প বলার খাঁচায় নিজেকে বেঁধে ফেলেননি। ষাটের দশকের সিনেমার নেপথ্যের ‘নায়ক’ যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে কখনওই নিজেকে বদলাননি। ওটিটি-যুগে আধুনিক সিনেমা অনেক দিন ধরেই ধুক ধুক করে শ্বাস নিচ্ছিল। মঙ্গলবার গোদারের মৃত্যুর সঙ্গে সে-ও চিরতরে চোখ বুজল।