মাকে নিয়ে ২১ দিনের লড়াইয়ের বর্ণনায় মেহুলি ঠাকুর। নিজস্ব চিত্র।
দিনগুলো যে কী ভাবে কেটে গেল! ২৭ জুন, আগামী সোমবার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। বোন মোনালি নিয়ম মেনে চার দিনের কাজ করেছে। আমি মুখাগ্নি করেছি। আমার কাজ ১১ দিনে। এই ক’টা দিন রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি! বারে বারে মায়ের মুখ ভেসে উঠেছে। আর মায়ের লড়াই। ২১টা দিন কী কষ্টই না পেল মা! এত কষ্ট কি পাওয়ার দরকার ছিল? চুপচাপ বসে থাকলেই ফিরে যাচ্ছি ২১ দিন আগে। ৩০ বছর ধরে হাই ব্লাড সুগার মায়ের। সঙ্গে কিডনি বিকল। ক্রিয়েটিনিন হাই, পার্কিনসন্স, স্নায়ুর রোগ, সাইকোসিস… আনুষঙ্গিক অনেক কিছু। এই সময় মায়ের ডিমেনশিয়া বাড়ত। যার থেকে অসংলগ্ন কথা বলে ফেলত। নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দিলেই মা আবার আগের মতো। এ ভাবেই মা এত দিন আগলে রেখেছে সবাইকে, সব কিছু। মায়েরা যেমন হয়। নিজেদের কথা না ভেবে বাকি সব কিছু নিয়ে ভাবতে বসে। অসুস্থ অবস্থাতেও।
এ বারও সেটাই হয়েছিল। একটু বেশি বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমরা আর বাড়িতে না রাখার সিদ্ধান্ত নিই। আমি, মোনালি— দু’জনেই। মাকে ভর্তি করা হল। সাইকোসিসের ওষুধও পড়ল। মায়ের অসুস্থতা কিন্তু কমল না! তবে তখনও জ্ঞান ছিল। বোনের হাতে খাবার খেল। কফি খাব বলে আমরা বাইরে এলাম। কিছু ক্ষণের মধ্যে ঘোষণা, মায়ের বাড়াবাড়ি। আইসিইউতে রাখতেই হবে। আমার স্বামী একটু দোনামোনা করেছিল। বলেছিল, “এত কষ্ট দিয়ে লাভ কী? তার থেকে বাড়িতেই থাকুন, যত দিন থাকবেন।” আমরা ঝুঁকি নিতে পারিনি। ফলে, মাকে আইসিইউতে নিলেন চিকিৎসকেরা। সারা শরীরে নানা রকমের নল। মা যেন কত দূরে চলে গেল! সেই দিন থেকে মা আবার লড়াইয়ে, আমরাও। রোজ বাড়ির কাজ সেরে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যেতাম হাসপাতালে। দূর থেকে হলেও মায়ের সঙ্গেই তো থাকতে পারব! বোন ওই দিনগুলো আমার কাছে, আমার বাড়িতে। এক বার করে মুম্বই ছুটছে। গানের কিছুটা রেকর্ডিং করছে। আবার ফিরছে শহরে। মায়ের কাছে। হাতের কাজগুলো কত দিন ফেলে রাখা যায়?
এ ভাবেই একটা করে দিন যাচ্ছে। মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। প্রশ্নও জাগছে, হাসপাতালে তো সবাই অসুস্থদের সুস্থ করে তুলতে পাঠায়। আমরা কি কোনও ভুল করছি? তত দিনে মা বাইপ্যাপে। সে দৃশ্য চোখে দেখার নয়। মনের দিক থেকে ক্রমশ ভেঙে পড়ছি। সমাজমাধ্যমের পাতায় বারে বারে সবাইকে অনুরোধ করছি, মায়ের জন্য যেন প্রার্থনা করেন। মাকে আমাদের যে খুব দরকার! এ ভাবেই চলতে চলতে মায়ের রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ল। এবং সেটা ঘটল হাসপাতালেই। চিকিৎসকেরা তখনও আশ্বাস দিচ্ছেন, আট রকমের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। দরকারে ভেটেরেনারি অ্যান্টিবায়োটিক (পশুদের ওষুধ?) দেওয়া হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো সেটাই বিশ্বাস করেছি। বোন এই অবস্থায় বাংলাদেশে গিয়ে অনুষ্ঠান করে এল। তাই নিয়ে কম সমস্যা? সামাজিক পাতায় নিন্দের ঝড়। কেউ লিখছেন, “মোনালির এত টাকার দরকার যে, এই অবস্থাতেও অনুষ্ঠান করলেন!” কারও কটাক্ষ, “পারল কী করে?” কিংবা “ও তো মায়ের কাছে মোটেই ছিল না!” এক দিকে মা চলে যাচ্ছে। অন্য দিকে, বোনকে নিয়ে অকারণ কটাক্ষ। কী ভাবে যে দিনগুলো কেটেছে, আমরাই জানি। সে সময় কাউকে বোঝাতেও পারিনি, ‘শিল্পের জন্যই শিল্পী শুধু’। আমাদের কথার খেলাপ করতে নেই।
মায়ের রক্তের সংক্রমণ কিন্তু কমল না। বুঝতে পারছি, দিন ঘনিয়ে আসছে। পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। তার মধ্যেও আমরা দু’বোন মায়ের পাশে। যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো চোখ মেলেছিল। আমাদের দেখল। আমরা বাইরে বেরোতেই সব শেষ। মা বুঝি আমাদের ফেলে যেতেও পারছিল না। তাই আমরা সরে যেতেই ছুটি নিল! সোমবার মাকে নতুন করে মনে করব। মা নিশ্চয়ই আমাদের বাবা শক্তি ঠাকুরের কাছে। যাঁকে দেওয়াল হয়ে আগলে গিয়েছে সারা জীবন।
জানি, মাকে ফেরাতে পারব না। তবু ছোট্ট জিজ্ঞাসা, আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাই অসুস্থকে সুস্থ করতে। আরও অসুস্থ করে ফেলতে? বাড়িতে রাখলে মা কি আরও কয়েক দিন বেশি থাকত? তবে কি রাজ্যের প্রথম সারির হাসপাতালগুলোর আরও সংস্কার প্রয়োজন?