(বাঁ দিক থেকে) গৌতম হালদার, ব্রাত্য বসু, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, নীল মুখোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সামনেই লোকসভা নির্বাচন। একের পর এক অস্ত্রে শান দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। কখনও রামমন্দির, কখনও সরকার বদল, কখনও ইডির ভয়। এ বার নতুন ফরমান জারি নাট্যজগতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গুণকীর্তন করে নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে, তবেই অনুদান পাবে বাংলা থিয়েটার দলগুলি। মঙ্গলবার এই ধরনের এক নির্দেশিকার কথা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেছেন নাট্যকার তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এই ঘটনায় স্তম্ভিত মন্ত্রী। ব্রাত্যের মতোই এই নির্দেশিকায় হতচকিত চেতনা নাট্যদলের অভিনেতা নীল মুখোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘চাপিয়ে দেওয়া’ এই নিয়ম মানবেন না জানালেন নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। যদিও নাট্যকার গৌতম হালদারের অবশ্য ভিন্ন মত। কেন্দ্রীয় সরকার কি অনুদান-জুজুর আড়ালে আসলে ভোটের আগে একপেশে প্রচারে ব্যস্ত? কী ভাবছে বাংলার নাট্যজগৎ? শুনল আনন্দবাজার অনলাইন।
মঙ্গলবার ব্রাত্য তাঁর পোস্টের সঙ্গেই কেন্দ্রের পাঠানো ছ’পাতার ছোট নাটিকাটিও পোস্ট করেছেন। হিন্দিতে লেখা সেই নাটকটির নাম ‘লে আয়ে ওয়াপস সোনে কি চিড়িয়া’ যার অর্থ সোনার পাখিকে ফিরিয়ে আনলাম। নাটকটি লিখেছেন ললিত প্রকাশ। যে ‘ফরমান’ জারি করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ২০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই নাটক এনএসডি-র (ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা) একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। নাটকটির মর্মার্থ কী তা-ও জানিয়েছেন (প্রধানমন্ত্রীর গুণকীর্তন বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী) ব্রাত্য।
এই নয়া ফরমান প্রসঙ্গে নীল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দীর্ঘ আট বছর ধরে চেতনা নাট্যদল অনুদান ছাড়াই নাটক করছিল। সবেমাত্র অনুদানের আওতায় পড়েছে আমাদের দল। তবে অনুদানের টাকা এখনও পাইনি। তার পরই এই নয়া নির্দেশিকা পেলাম। আপাতত আমাদের কাছে যে নির্দেশিকা এসেছে তাতে তিনটে বিষয় বেছে দেওয়া হয়েছে। তাঁর উপর স্বল্পদৈর্ঘ্যের নাটক করতে হবে। বিষয় তিনটি পেয়ে আমি রাজনীতির গন্ধ পাইনি। তা ছাড়া চিত্রনাট্যগুলো হিন্দিতে, বাংলায় এখন চিত্রনাট্য পাইনি। তাই পড়ে উঠতে পারিনি। তবে এই ঘটনাটা একেবারে নতুন। এত বছরের ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি। খানিকটা চাপিয়ে দেওয়াই বটে।’’
কিন্তু যে নাটকটা মঞ্চস্থ করা হবে তাতে কি অভিনেতা নীলকে দেখা যাবে? তাঁর উত্তর, ‘‘না, আমি একেবারেই থাকছি না। দলের ছেলেমেয়েদের বলেছি। ওরা করতে পারলে করবে, না করলে করবে না। তাতে যদি অনুদান বন্ধ করে দেয়, করবে। আমি সেটা মেনে নেব। এর পিছনে কোনও প্রচারমূলক চিন্তা কাজ করছে কি না তা টেক্সট না পড়লে বলতে পারছি না।’’
খ্যাতনামী নাট্যকার গৌতম হালদার। তাঁর নাট্যদলের নাম ‘নয়ে নাটুয়া’। তিনি অবশ্য জানালেন, যাঁরা অনুদান পান তাঁরা তো নাটকটা করছেন। তবে ভোটের আগে আচমকা এমন নির্দেশিকায় কি রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন তিনি? খানিক হেসেই জানান, তিনি রাজনীতির লোক নন, তাই এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না। অতীতে এমন ঘটনার তেমন কোনও দৃষ্টান্ত নেই বলে স্বীকার করে নেন নাট্যকার। গৌতমের কথায়, ‘‘নাটকের দল খুব কষ্ট করেই চলে।তাই অনুদানটা বাঁচাতে সবাই চায়। আমি করছি নাটকটা, বলেছে যখন করতে, তখন করব। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দিচ্ছে তাই যখন বলছে করতে হচ্ছে। নাটকের দলগুলি খুবই বঞ্চিত, তাই এই অর্থের প্রয়োজনও রয়েছে।’’
বাংলা নাট্যজগতের অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ‘ফ্যাতাড়ু’, ‘ব্রেইন’ এর মতো নাটকে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর সাফ কথা, ‘‘আমার অনুদান কেড়ে নেওয়া হোক কিংবা আমাকে নিষিদ্ধ করা হোক এই নাটক আমি করব না।’’ এর পিছনে তাঁর যুক্তি এই নাটক মূলত বিজেপি, মোদী সরকার ও আরএসএসের ‘প্রোপাগান্ডা’। দেবেশ বলেন, ‘‘আসলে আমাদের যে নোটিসটা পাঠানো হয়েছে সেখানে লেখা আছে এটা আমাদের করতেই হবে। একটা ভয় তৈরি করা হচ্ছে। মানে তুমি না করলে তোমার অনুদান বাতিল।’’ ব্রাত্য তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটার দলগুলি যে হেতু বামপন্থী সেকুলার, তাই আমরা আশা রাখতেই পারি, এই নির্লজ্জ প্রস্তাব তারা সবাই ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবে।’’ যদিও দেবেশের দাবি, ‘‘বাংলার প্রগতিশীল বামমনস্ক নাট্যদলগুলি মোদীর এই প্রচারমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। এটা দুর্ভাগ্যজনক।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের এই নয়া নির্দেশিকা ঘিরে যেমন বিভ্রান্তি রয়েছে তেমনই দু’টি দলে আড়াআড়ি বিভক্ত হয়েছে নাট্যজগৎ। শেষে পাল্লা ভারী হয় কোন দিকে, সেটা সময় বলবে।