কলকাতায় মার্কো লিওনার্দি, কথা বললেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত।
রবিবার শহর কলকাতায় মার্কো লিওনার্দি। পরিচালক গৌতম ঘোষের ‘পরিক্রমা’ ছবির মাধ্যমে ভারতীয় ছবির জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন ইটালির অভিনেতা। ‘মারাদোনা দ্য হ্যান্ড অফ গড’, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মেক্সিকো’ বা ‘সিনেমা পারাদিসো’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা মার্কোর অভিনয়ে মুগ্ধ। অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম। চার বছর বয়সে ইটালি শহরে জীবনযাপন শুরু। ১৭ বছর বয়সে ইটালির ছবি ‘সিনেমা পারাদিসো’ ছবিতে অভিনয় করে শিরোনামে আসেন তিনি। এর পর ‘লাইক ওয়াটার ফর চকোলেট’, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মেক্সিকো’, ‘ফ্রম ডাস্ক টিল ডন: দ্য হ্যাংম্যান্স ডটার’, ঝুলিতে একের পর এক বড় ছবি।
ছুটির দিন নন্দনে দর্শকের ঢল, বিদেশি ছবির আকর্ষণে। এ সব দেখতে দেখতে তিনি যখন সাংবাদিক সম্মেলনে পা রাখলেন তত ক্ষণে মিনিট পনেরো দেরি হয়ে গিয়েছে। আপাদমস্তক কালো পোশাক। বয়স ৫৩-এর কোঠায়, সুঠাম দেহ, মাথার চুল, দাড়ি-গোঁফের অধিকাংশই সাদা। চওড়া হেসে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন। বললেন, “নির্দিষ্ট সময় থেকে ১৫ মিনিট দেরি। আন্তরিক দুঃখিত। আমার দেরি হওয়ার কারণ শহরের যানজট।”
কলকাতার যান চলাচল সম্পর্কে যাঁদের সম্যক ধারণা রয়েছে, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে ততটাও মাথা ঘামান না। মার্কো লিওনার্দি শহরে প্রথম। কলকাতা কি তাঁর মনখারাপ করে দিল? আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রেখেছিল তাঁর কাছে। ভীষণ সহজ গলায় বললেন, “একেবারেই না। প্রথম এলাম শহরে। চারপাশে হৃদয়ের উষ্ণতা। আমি অনুভব করতে পারছি। দেখুন না, ‘পরিক্রমা’ দেখার জন্য নন্দনে কত মানুষের ভিড়।” রবিবার সারা দিন তিনি শহরে। নন্দন ছাড়াও আনাচকানাচে ঘুরবেন, এমনই ইচ্ছে। কলকাতার কোনও বিশেষ খাবার খাওয়ার ইচ্ছে? ছেলেমানুষের মতো অসহায় গলায় জানালেন, কোনও খাবারের নাম জানেন না। কিচ্ছু জানেন না এ বিষয়ে। বরং কেউ তাঁকে জানিয়ে দিলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।
গৌতমের ছবির প্রেক্ষাপটে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন। এক মাতৃহারা, গৃহহারা কিশোর সেই গল্পের মানবিক দিকটি তুলে ধরেছে প্রখর ভাবে। ছবির বিদেশি প্রযোজক ৫২ বার কলকাতায় এসেছেন। মার্কোর তা হয়নি। তাঁর চরিত্রের নাম ‘অ্যালেক্স’। তিনি এই ছবিতে অভিনয়সূত্রে শুটিংয়ের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে। মধ্যপ্রদেশ দিয়ে তাঁর ভারত পরিক্রমা শুরু। দেশটিকে কেমন দেখলেন? বিদেশি অভিনেতার কথায়, “একটি দেশে এত বৈচিত্র্য দেখব আশাই করিনি। এত ভাষাভাষী, এত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য মুগ্ধ করেছে আমাকে। একই সঙ্গে ভারতীয়দের আতিথেয়তা, আন্তরিকতার প্রেমে পড়ে গিয়েছি!” তবে নর্মদা নদী দেখে তাঁর মনখারাপ। মার্কোর কথায়, “প্রথম যখন নর্মদা নদীর কথা শুনি, ভেবেছিলাম স্বচ্ছ, খরস্রোতা জলধারা দেখব। উৎস অঞ্চলে নদী তেমনই। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আচমকা গতি স্তব্ধ। শ্যাওলা জমে সবুজ রং। নর্মদা মরে গিয়েছে!” দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন অভিনেতা।
তবে ছবিতে অভিনয় করে তিনি তৃপ্ত। জানিয়েছেন, লেখকের থেকে গল্প শোনার পরেই তিনি ছবিটি করতে রাজি হয়ে যান। প্রথমে নদী সম্পর্কে জানেন। তার পর ভারত সম্পর্কে। খুঁটিয়ে গল্প পড়ে নিজেকে ছবির জন্য তৈরি করেন। বাকিটা পরিচালকের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। গৌতমকে নিয়েও উচ্ছ্বসিত তিনি। বললেন, “অদ্ভুত পরিচালক। পুরো চরিত্র গল্পের মতো করে বুঝিয়ে দেন। তা ছাড়া, ছবি সম্পর্কে পাণ্ডিত্যও প্রবল। গৌতমের মতো পরিচালকের ছবি দিয়ে ভারতীয় ছবিতে পা রাখলাম। খুব গর্ব হচ্ছে।”
আগামীতে নিশ্চয়ই আরও ভারতীয় ছবিতে অভিনয় করবেন? “অবশ্যই করব”, আশ্বাস বিদেশি অভিনেতার কথায়। হলিউড আর ভারতীয় ছবির মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখলেন? মার্কোর জবাব, “কোনও ফারাক নেই। দুই দেশের ছবিতেই লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরা-অ্যাকশন বলা হয়। অভিনেতারা অভিনয় করেন। সেই অভিনয় দেখে দর্শক হাসেন-কাঁদেন।” তাঁর মতে, যে যার মতো করে গল্প বলে। ভারতে অভিনয় করে গেলেন। মনে রাখার মতো কোনও স্মৃতি? ফের সারল্যমাখা খুশি তাঁর চোখেমুখে। ঝকঝকে হাসি উপহার দিয়ে বললেন, “এই প্রথম বাঁদরের সঙ্গে অভিনয় করলাম! একসঙ্গে সকালের জলখাবার খেলাম। ভাবা যায় না। ওরাও কিন্তু প্রচণ্ড সহযোগিতা করেছে। একটুও সমস্যায় ফেলেনি। নইলে ছবির একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শুটিং হত না।”
গৌতম ঘোষের ঝুলিতে ‘সেরা ছবি’র লম্বা তালিকা। ‘পরিক্রমা’ ছবিটি কি অন্যতম ‘সেরা ছবি’র তকমা পাবে?
পরিচালক আর অভিনেতার কাছে একসঙ্গে এই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। পরিচালক স্বভাবজাত বিনয়ে হেসে এড়িয়ে গিয়েছেন। মার্কো লিওনার্দি কিন্তু সপাট। তাঁর মতে, তিনি ছবিতে অভিনয়ের আগে বেশ কিছু এ দেশের ছবি দেখে ফেলেছেন। সেই সুবাদে তাঁর বিশ্বাস, গৌতমের এই ছবিটি সত্যিই অন্যতম ‘সেরা’।