‘মানবজমিন’-এর মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনে আড্ডায় শ্রীজাত। —ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: বেশ তো ছিলেন কবি। হঠাৎ ছবি করার পোকা কেন কামড়াল?
শ্রীজাত: এটা আসলে অনেক দিনই কামড়েছে। আমার কৈশোর থেকেই ছবি দেখার তুমুল নেশা। তখন থেকেই মনে হত যে, ছবির মতো শক্তিশালী মাধ্যম খুব কম আছে। কেন না, ছবিতে সব শিল্পমাধ্যমের একটা মিলমিশ হয়। অনেক দিন থেকেই এই স্বপ্ন লালন করা। চিত্রনাট্য লিখে, গল্প লিখে নিজের কাছে ছিল। শেষ পর্যন্ত এই ২০২২ সালে একটা কাজ করার সুযোগ ঘটল। রানা (সরকার, প্রযোজক) খুব খুশি হয়ে রাজি হল ছবিটা করতে। আমিও কপাল ঠুকে এগিয়ে গেলাম।
প্রশ্ন: ‘মানবজমিন’-এর ভাবনাটা কী ভাবে?
শ্রীজাত: এক দিকে রয়েছে গ্রামের বাচ্চা মেয়েদের একটা স্কুল। যারা খুবই গরিব। সেই স্কুল ঘিরে একটা সমস্যা তৈরি হয়। অন্য দিকে, প্রেম, স্নেহ, বাৎসল্য— তার একটা টানাপড়েন। এই গোটাটার মধ্যে একটা হাস্যরসেরও জায়গা আছে। সব মিলিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি, একটা সামঞ্জস্য রেখে একটা ছবি তৈরি করার। কোনও দিকেই বেশি ঢালু নয়। এবং সোজা, সরল, সাদামাটা একটা গল্প বলার। কোনও প্যাঁচ-ট্যাঁচ ছাড়া।
প্রশ্ন: আপনি ইতিমধ্যেই আপনার দ্বিতীয় ছবি ঘোষণা করে ফেললেন। প্রথম ছবিটা যদি না চলে?
শ্রীজাত: এটা ভাল না করলে ঝুঁকি রানার, আমার নয়। কারণ, প্রথম ছবিটা করার পর রানার খুব ভাল লেগেছে। দ্বিতীয় ছবির প্রস্তাবটা রানার কাছ থেকেই এসেছিল। এই বাজারে এক জন পরিচালকের কাছে এটা একটা স্বপ্নের বিষয় যে, এক জন প্রযোজক একটা ছবির মুক্তির আগেই আরও একটা ছবি সই করতে চাইছেন। ওর কোথাও একটা ভরসা, আস্থা আছে। পরম (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) তো এক কথায় রাজি হয়েছে। পুরো গল্পটা শোনেওনি। আর সোহিনীর (সরকার) সঙ্গে আমার অনেক দিন ধরে কাজ করার ইচ্ছে। মনে হল, ছবিটা অল্প সময়ের মধ্যে করা যাবে। এবং অন্য রকম একটি ছবি হবে।
প্রশ্ন: পরিচালকদের মধ্যে আপনার অনুপ্রেরণা কারা?
শ্রীজাত: প্রচুর আছে। কিন্তু বাংলায় বলতে গেলে যাঁরা সবার অনুপ্ররণা, তাঁরাই। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল বাদ দিয়ে আমার আরও এক ধরনের ঘরানার ছবি ভীষণ ভাল লাগে। যেমন তপন সিন্হা। আমার তাঁকে এক জন অসাধারণ পরিচালক বলে মনে হয়। আমার খারাপ লাগছে বলতে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। যে খ্যাতিটা বা জায়গাটা ওঁর পাওয়ার কথা ছিল, উনি পাননি। আর আমার ভীষণ ভাল লাগে তরুণ মজুমদার। এমনকি, আমি বলব অজয় করও। কী অসামান্য সব প্রেমের ছবি বানিয়েছেন। ওই গল্প বলার ক্ষমতা আমাদের এখন চলে গিয়েছে। আমরা গল্প ভাবলে প্রথমেই ভাবি, কী টুইস্ট আনব, কী সাসপেন্স দেব। একটা ‘গল্প হলেও সত্যি’-র মতো গল্প আমরা ভাবতে পারি না। হয়তো আমরাই পারছি না। বা এটাই সময়ের দাবি।
প্রশ্ন: তা, এঁদের ছায়া কি আপনার ছবিতে পড়েছে?
শ্রীজাত: আমি চেষ্টা করেছি দুটো জিনিস। একটা হল খুব সরল ভাবে গল্প বলা। আর দ্বিতীয় হল— হয়তো নিজের মুখে বলা ঠিক হবে না, একটা বুদ্ধিদীপ্ত, স্বাভাবিক রসবোধ রাখার। এখন তো সব কিছুকে লঘু করে দিলে লোকে হাসে। এটাই রসবোধের একটা বিকল্প হয়ে গিয়েছে। আমি এটাতে বিশ্বাস করি না। আমি তরুণ মজুমদারের রসবোধটায় বিশ্বাস করি। ‘দাদার কীর্তি’-র রসবোধটা আমার খুব পছন্দ। সেটাই আমি রাখতে চেয়েছি আমার ছবিতে। পেরেছি কি না, সেটা আপনারা বলতে পারবেন।
প্রশ্ন: অমিতাভ বচ্চন এ বারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাক্স্বাধীনতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। আপনারও কি মনে হয় আমাদের দেশে বাক্স্বাধীনতার অভাব?
শ্রীজাত: এটা সব শিল্পীরই প্রশ্ন। যে তাঁর বাক্স্বাধীনতা কতটা আক্রান্ত, কতটা আছে, বা নেই। অনেক সময় কথা বলতে গিয়ে পারিনি, এ রকম মনে হয়েছে। তবে আমার এখনও মনে হয় যে, আমরা ভারতবর্ষে বা পশ্চিমবঙ্গে অনেক অনেক মানুষের চেয়ে বেশি বাক্স্বাধীনতা পাই। কারণ, আমি এ রকম অনেক জায়গায় গিয়েছি যেখানে মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। আমরা তবু পারি। সেই কথার বিরুদ্ধে দশটা সওয়াল উঠতে পারে। সেগুলো ওয়েলকাম। কিন্তু কথাই বলতে পারব না, কথা বললে গলা নামিয়ে দেবে, এই পরিস্থিতিতে আমরা এখনও পৌঁছইনি। আমি আশা করব, কোনও দিন পৌঁছবও না। এবং শিল্পীর ক্ষেত্রে বাক্স্বাধীনতা তো খুবই প্রয়োজনীয়।
প্রশ্ন: আপনি বলতে চান এ রাজ্যে আপনার বাক্স্বাধীনতা নিয়ে কোনও অসুবিধে হয়নি?
শ্রীজাত: এখনও পর্যন্ত তো আমার রাজ্যে আমি কোনও দিন পড়িনি সে রকম অসুবিধায়। তবে ট্রোলিং হয়। আপনি একটা কথা লিখলে সেটাকে নস্যাৎ করা— এটা ছিল না। এটা সমাজমাধ্যমের অবদান। মানুষ ব্যক্তি আক্রমণে নেমে আসেন। ছবি দেখব না, ছবি বয়কট করব, আপনার কবিতা পড়ব না— এগুলো নিয়ে আমি খুব একটা ভাবি না। বাকিদের কথা আমি জানি না। সেই নিয়ে মন্তব্যও করব না। কারণ আমি কোনও কিছুতে রাজনীতির রং দিতে চাই না। আমি অন্তত এখনও পর্যন্ত আমার কথা লিখতে বা বলতে পেরেছি। যদি কোনও দিন না পারি, তখন সেটা বলব।
প্রশ্ন: যে সব ঘৃণাবাহিনী আপনাকে ‘পা-চাটা তৃণমূলী বুদ্ধিজীবী’ বলে তাঁদের আপনি কী বলবেন?
শ্রীজাত: আমি কিচ্ছু বলি না। কারণ আমার একদম সময় নেই। উৎসাহও নেই। অনেকে অনেক কিছু বলে। আমি জানি আমি কী। যত ক্ষণ পর্যন্ত আমি নিজের কাছে পরিষ্কার, তত ক্ষণ আমি কাউকে জবাবদিহির ধার ধারি না। আর কোনও দিন ধারবও না।
প্রশ্ন: আপনি কি নিজেকে বুদ্ধিজীবী মনে করেন?
শ্রীজাত: না। অত বুদ্ধি আমার নেই। আমি এক জন সাধারণ কর্মী। আমি বছর তিরিশেক কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। সেটা এখনও চলছে। এবং আমি একটা ছবি করার চেষ্টা করলাম। দেখা যাক, সেটা কেমন হয়।
প্রশ্ন: ক্ষমতার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলে কি শিল্প বা শিল্পী প্রভাবিত হয়?
শ্রীজাত: আমার মনে হয় না। কাছাকাছি পৌঁছনোর দু’রকম বিষয় আছে। একটা শারীরিক দূরত্ব। অন্যটা মানসিক দূরত্ব। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও বহু লোক বহু সফল শিল্প করেছেন। আবার প্রচুর দূরে গিয়েও অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন। এটার কোনও ফর্মুলা নেই। যে ক্ষমতার কাছে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। নষ্ট হয়েও যেতে পারে। কথা হচ্ছে, কে যাচ্ছে ক্ষমতার কাছে? তার কতটা ক্ষমতা আছে?
প্রশ্ন: আপনার কবিতা লেখা কত দূর?
শ্রীজাত: চলছে। আমার নতুন কবিতার বই ছাপতে গিয়েছে। প্রেসে এখন।
প্রশ্ন: কী নাম?
শ্রীজাত: সেটার নাম ‘আপেল-কাটার ছুরি ও স্থানীয় করাতকল’। একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন লেখা। একটা ছায়াময় লেখা। সেটা ছাপতে গিয়েছে। বইমেলার আগে আশা করছি চলে আসবে।
প্রশ্ন: লেখার সময় রাজনীতি আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
শ্রীজাত: খুব একটা করে না।
প্রশ্ন: কেন?
শ্রীজাত: তার কারণ হচ্ছে যে, আমি যদি রাজনীতিকে দলীয় রাজনীতি বলি, সেটার প্রভাব আমার উপর খুব একটা নেই যে, রাজনীতি করব। কিন্তু সব মানুষেরই নিজস্ব রাজনীতি থাকে। কেউ যদি বলে আমি অ-রাজনৈতিক, সেটা ঠিক নয়। আমাদের এখানে রাজনীতি কথাটার এমন একটা মানে হয়েছে...।
প্রশ্ন: কী মানে হয়েছে?
শ্রীজাত: যে রাজনীতি মানেই সে একটা দল করে। সে ক্ষমতা চায়। ক্ষমতার বিরোধিতা চায়। কিন্তু তার বাইরেও রাজনীতি আছে। একটা মানুষ যদি স্কুল করতে চায়, একটা মানুষ যদি এক জন সব-খোয়ানো মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়— এগুলোও রাজনীতি। এ সব করতে গেলে যে দল করতে হবে এমন কোনও মানে নেই। আমি সেই ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। আমি কবিতায় কিছু কথা বলতে চাই। সেটাই আমার রাজনীতি। সব সময় দলের সঙ্গে যোগস্থাপন করতে হবে আমার সে রকম বিশ্বাস নেই।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপনার কেমন লাগে?
শ্রীজাত: আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওঁর সঙ্গে মিশিনি। কিন্তু আমার মনে হয় যে, ওঁর অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে। ক্ষমতা আছে। করেওছেন অনেক কিছু। যেটা আমার সব চেয়ে মনে হয়, উনি সেই সব মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন, যাঁরা শিল্পর সঙ্গে যুক্ত। সেটুকু আমি শিল্পী হিসাবে, নাহ্ শিল্পী বলব না নিজেকে... কিন্তু তা-ও এটা বলতে পারি। রাজনীতি আমার বিষয় নয়। সেটা নিয়ে আমি মুখ খুলবও না। কারণ আমার মনে হয়, সবাই সব কিছু নিয়ে কথা বলার যোগ্য নয়। আজকাল একটা সময় এসেছে, সবাই সব কিছু নিয়ে কথা বলে। আমার একদম পছন্দ নয় সেটা। বা বলতে পারেন আমার অত জ্ঞান নেই। তো উনি শিল্পীদের জন্য অনেক কিছু করেন। অনেক মঞ্চ তৈরি করেছেন। অনেক শিল্পী তাতে উপকৃত হয়েছেন। তাঁরা গানবাজনা করছেন। কাজ পাচ্ছেন। যেটা আমাদের জন্য খুব ভাল বলে আমার মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনি নিজেকে শিল্পী বলছেন না। তা হলে কী বলবেন?
শ্রীজাত: শিল্পী অনেক বড় বিষয়। আমি নিজেকে কবিতা-কর্মী বলব।