স্বপন দেবনাথের ‘মেয়েদের মদ্যপান’ মন্তব্যে মুখ খুললেন টলিপাড়ার অভিনেত্রীরা। গ্রাফিক : সনৎ সিংহ।
আরজি কর-কাণ্ডে শহর জুড়ে প্রায় দেড় মাস ধরে লাগাতার প্রতিবাদ। আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি ছেলে ও মেয়ের বিয়ার পান দেখে চটে যান রাজ্যের মন্ত্রী। নারী-স্বাধীনতা নিয়ে প্রত্যক্ষ মন্তব্য করেন তিনি। ভারতে লিঙ্গবৈষম্য দিন দিন এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পূর্বস্থলী দক্ষিণের বিধায়ক তথা প্রাণীসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের করা মন্তব্যে ইতিমধ্যেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। তাঁর দাবি, ‘রাত দখল’ কর্মসূচিতে গিয়ে গভীর রাতে মদের দোকানে যাচ্ছেন মহিলারা। মদ কিনে খাচ্ছেন। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য আলাদা করে সতর্ক থাকতে হচ্ছে প্রশাসনকে। স্বপন থেমে না গিয়ে আরও বলেন, ‘‘আমার এলাকায় (পূর্বস্থলী দক্ষিণ বিধানসভা) দেখেছি, একটি দোকানে রাতে মেয়েরা মদ কেনেন। খবরটা পাওয়ার পর আমি দু’দিন পর পর সেখানে রাতে গিয়েছি। কোন মেয়েরা হোটেলে মদ খেতে যায়, সেটাও দেখতে গিয়েছি। আমি হোটেলওয়ালাকে বলে এসেছি, এখন থেকে আর কোনও মহিলাকে সেখানে মদ খেতে দেওয়া যাওয়া যাবে না।’’
মেয়েদের ঠিক কী করণীয় তা নিয়ে? তাঁদের কতটা স্বাধীনতা রয়েছে সেই বিষয়ে? সমীক্ষা বলছে, লিঙ্গবৈষম্যের নিরিখে নারী-পুরুষের অসাম্য ক্রমেই বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, তবে নারীর অধিকার ঠিক কত দূর পর্যন্ত প্রসারিত? মদ্যপান কি শুধু নারীদের জন্যই ক্ষতিকারক? প্রশ্ন তুলছেন টলিপাড়ার নারীরা।
সম্প্রতি কানাডিয়ান নৃত্যশিল্পী, মডেল, অভিনেত্রী ও গায়িকা নোরা ফতেহির সাক্ষাৎকারের একটি অংশ সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যে অংশে তিনি বলছেন, নারীবাদ জিনিসটা প্রাথমিক ভাবে ভাল, কিন্তু তার একটা সীমা থাকা দরকার। চরমভাবাপন্ন নারীবাদ সমাজের সর্বনাশ করছে। নারী স্বাধীন হতেই পারেন, তাঁর পড়াশোনার অধিকার আছে, কাজেরও অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই সবের একটা সীমা আছে। কোথাকার সীমা? কেই বা ঠিক করবে? এ বার নারীদের সীমা নির্ধারণের কাজটিই কি করছেন রাজ্যের মন্ত্রীরা বা সমাজ?
অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তের কথায়, ‘‘আমার অবাক লাগছে এটা ভেবে যে, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একসঙ্গে বসে বিয়ার খাচ্ছেন, এই দৃশ্যটা এই আন্দোলনের আগে কখনও কলকাতার বুকে ঘটেনি, তাই কি ওঁর এমন মনে হয়েছে! এখন সব দোষ দেওয়া হচ্ছে আন্দোলনের দিকে। আসলে আন্দোলনকে অজুহাত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে বিভিন্ন কারণে।’’ সম্প্রতি ‘অপরাজিতা বিল’ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ রাজ্যকে দিয়েছে, সেই প্রসঙ্গ তুলে দেবলীনা বলেন, ‘‘ মেয়েদের সুরক্ষার প্রয়োজন। তাই বলে তাঁদের বিচ্ছিন্ন ভাবার দরকার নেই, সুপ্রিম কোর্টই বলেছে। মেয়েদের রক্ষা করার জন্য তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা আনা মানেই কিন্তু লিঙ্গবৈষম্যের দিকে চলে যাওয়া। এমনও তো হতে পারে, ছেলেদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। তা হলে কি কোনও ছেলে কখনও মদ খাবে না? এ রকম কিছু করলেও মেয়েরা সুরক্ষিত থাকত। একটা উদাহরণ দিলাম। মেয়েদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলেই তাঁদের সুরক্ষিত করা যায় না। মেয়েরা মদ খাবেন না, এই কথাটা আসছে কোথা থেকে? আমি কিন্তু নিজে মদ ছুঁয়েও দেখি না। আসলে বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার। আমি নিজে মদ স্পর্শ করি না, আবার কোনও মহিলা মদ খেতে চাইলে তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতেও চাই না। কারণ, এর সঙ্গে সুরক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই।’’
এমনিতেই দেশের সংসদে জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মহিলা মুখ মাত্র ১৩.৬ শতাংশ। তার মধ্যে সর্বাধিক মহিলা প্রতিনিধি যে দলের, সেটি এ রাজ্যেরই শাসক গোষ্ঠীর। সেই দলের মন্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে অভিনেত্রী সঙ্ঘশ্রী সিংহ বলেন, ‘‘বেশি কথা বললেই বাজে কথা আসে। ওঁর দলের অনেক মহিলা বিধায়ক কিংবা সাংসদ আমাদের বন্ধুবান্ধব। সকলেই তো পার্টি করেন, অনেকেই মদ্যপানও করেন। তাতে কিন্তু কোনও ক্ষতি নেই। প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী মহিলা । তাঁরা যা খুশি করতেই পারেন। ওঁর কি তাতেও সমস্যা? আমার ইচ্ছে হলে মদ খাব, না হলে খাব না। আমার ইচ্ছে হলে ধূমপানও করতে পারি। অনেক জিনিস শরীরের পক্ষে খারাপ জেনেও তো করি আমরা। আমি স্বাধীন দেশে কারও ক্ষতি না করে যা খুশি তা-ই করতে পারি। নারীসুরক্ষার নামে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ তো মানব না! রাজ্যে আবগারি দফতর থেকে অনেক টাকাই আয় হয়। এ সব বাজে কথা না বলে উনি বরং চুপচাপ দ্বীপান্তরী হয়ে যান। চুপ করে থাকুন।’’
টেলিভিশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ অভিনেত্রী সন্দীপ্তা সেন। টেলিভশনের পর্দায় তাঁর ভাবমূর্তি 'ভাল মেয়ে'র। তিনি অবশ্য মেয়েদের মদ খাওয়া নয়, ছেলেদের মদ খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মদ খাওয়াটা জানি ছেলেমেয়ে সকলের জন্যই খারাপ। যে সব পুরুষ এ সব কথা বলেন, তাঁদের বাড়ির মহিলারা কী ভাবে থাকেন, তা নিয়ে চিন্তা হয়। মেয়েদের সমানাধিকার নিয়ে চারপাশে কথা হলেও পুরুষতন্ত্রকে এ বার শেষ করতে হবে। আসলে যাঁরা নারীসুরক্ষার অছিলায় মেয়েদের উপর নিষেধ আনতে চাইছেন, বুঝতে হবে, সমস্যা তাঁদের মধ্যে এবং এই সমাজের মধ্যেই।’’