‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এর মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনে আড্ডায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ছবি মুক্তির আগে পরিচালক-অভিনেতার কতটা ভয় করে? সেটা আপনারা আলোচনা করেন?
কৌশিক: ছবি মুক্তির আগে আমরা যে ভাবে অপেক্ষা করি, তাতে আমাদের শরীরের মধ্যে যে কী চলে, সেটা অন্য কেউ বুঝতে পারবেন না। অনেকে এগুলো সহজে মেনে নিতে পারেন। ধরে নেন, ঠিক আছে, যা হবে দেখা যাবে। কিন্তু আমি বুম্বাদাকে ধরেই বলছি, আমাদের এমন মানসিকতা নয়। আসলে সব ছবির বাজেট এক হয় না। যা চাইছি, তেমনই প্রচার করা যায় না। চাইলেই কোনও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমে বড় বিজ্ঞাপন দিতে পারি না। তাই মানুষকে জানানোর দায়িত্ব পুরোটাই আমাদের উপর পড়ে যায়। ছবি ভাল না খারাপ, সেটা তো পরের কথা। কিন্তু দর্শককে জানানো প্রয়োজন যে ছবিটা মুক্তি পাচ্ছে। তাই সাধ্যমতো সেগুলো আমরা চেষ্টা করি।
প্রসেনজিৎ: একদমই তাই।
প্রশ্ন: এই নিয়ে চতুর্থ বার একসঙ্গে কাজ করবেন আপনারা। নিশ্চয়ই আগের চেয়ে দু’জনেরই মধ্যে তালমিলটা এখন অনেক বেশি পোক্ত?
কৌশিক: ‘কিশোর কুমার জুনিয়ার’ প্রথম কাজ ছিল। তার পর ‘দৃষ্টিকোণ’ এবং ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’। তার পর এই চতুর্থ কাজ ‘কাবেরী অন্তর্ধান’। এখন আমাদের কাজের বাইরেও একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোনও রকম অসুবিধা হলে আমি বলতে পারি। বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। তবে বুম্বাদা কিন্তু আমার অন্যান্য বন্ধুদের মতো নয়। ইন্ডাস্ট্রির কে কী করল, কে ঠিক করল, কে ভুল করল, সে সব কখনও আলোচনা হয় না।
প্রসেনজিৎ:আসলে ওই ধরনের গল্প করা আমার চরিত্রই নয়।
কৌশিক: কাজের বাইরে, সিনেমার বাইরে কোনও দিন কোনও কথা হয়। ‘‘কী ভাবছিস, কোনও গল্প নিয়ে কতটা এগোলি’’— এইটুকু। আমার কোনও গল্প তৈরি হয়ে গেলে ফোন করে যেমন বলি, ‘‘দেখা করতে পারবে, দরকার আছে।’’ ওই ‘দরকার আছে’ শুনলেই বুম্বাদা বুঝে যায়।
প্রসেনজিৎ: অন্য সময় বাড়ি এল, আড্ডা হয়। মাঝেমাঝে আমি আবার মনে করাই, কোনও গল্প কতটা ডেভলপ করল। কিন্তু যেই ফোন করে বলে, ‘‘সময় হবে?’’ তখনই আমার উত্তেজিত লাগে। ওই অপেক্ষাটা আমার কাছে খুব এক্সাইটিং। আসলে আমি তো একজন ক্ষুধার্ত অভিনেতা। তাই কৌশিক, সৃজিত (মুখোপাধ্যায়), অতনুরা (ঘোষ) যখন আমায় বলে, ‘‘দরকার আছে’’, আমি জানি খুব সাদামাটা কিছু আমার কাছে আসবে না। সারা বছর তো আমি অপেক্ষাই করে থাকি এই বাবুদের থেকে ফোন পাওয়ার জন্য (মুচকি হেসে)। গল্প শোনার আগে পর্যন্ত একটা উৎকণ্ঠা কাজ করে। শোনার পর বেশির ভাগ সময় ভাল লাগে, আর তখন বলি কাজটা নিয়ে এগোতে। সিনেমা নিয়ে সব সময়ই কথা হয়। এর মাঝে অবশ্য সকলেই অন্য ছবিও করে। কিন্তু তা-ও আমি জানি, আমার জন্য গল্পের খোঁজ জারি থাকে।
কৌশিক: ওটা সত্যিই একটা খোঁজ। যে মানুষটার উপর ৩০০-৩৫০টা ছবি হয়ে গিয়েছে, তার ভিতর থেকে নতুন কিছু বার করে আনাটা সত্যিই কঠিন। আর তাঁর স্টারডম আছে, ক্যারিশ্মা আছে। সেগুলো ছাপিয়ে নতুন ভাবে নিজেকে মেলে ধরা খুব কঠিন কাজ। তবে ‘কাবেরী...’র জন্য সেটা খুব ভাল ভাবে করেছে বুম্বাদা। এই ছবির আগে চার-পাঁচ মাস কোনও কাজ করেনি। ও রকম একমুখ দাড়ি, চুল— উইগ পরে সম্ভব ছিল না। পুরো চরিত্রের মধ্যে ঢুকে বুম্বাদা নিজেকে তৈরি করেছে।
প্রশ্ন: প্রসেনজিতের জন্য তা হলে গল্প বাছাটাও তো খুব কঠিন হয়ে যায়?
কৌশিক: সে তো বটেই। কারণ আমরা আসলে কোনও গল্প নিয়েই তো নিশ্চিত হতে পারি না।
প্রসেনজিত: না, এখন কিছু নিয়েই শিওর হওয়া যায় না।
কৌশিক: বিশেষ করে অতিমারির আগে-পরে অনেক বদলে গিয়েছে। কোনও রকমে গল্প ভেবে এক ‘ক্যাচ’ দিয়ে ভাবলাম দর্শক খেয়ে যাবে, সেটা এখন হয় না। দর্শককে ঠকানো মুশকিল। আন্তরিকতার বদলে যদি ভাবি একটা প্রজেক্ট করছি, তা হলে মুশকিল। ‘কাবেরী…’ মূল গল্পটা খুব ইনটেন্স। তার জন্য ক্যামেরার কায়দাবাজি, জিম জিপের চোখধাঁধানো শট, সাউন্ডস্কেপ দিয়ে ভয় দেখানোর মতো কোনও রকম কায়দা আমরা এ ছবিতে করিনি। প্রেম-বিপ্লব, যৌবন-রহস্য, সব মিলিয়ে পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপটের গল্প।
প্রসেনজিৎ: কৌশিক যে ভাবে এই গল্পের বাঁধনটা ভেবেছে, সেটা আমার ইউনিক লেগেছে। এটা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি নয়। সব চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কৌশিক সেন, শ্রাবন্তী, চূর্ণী— যে হেতু পরিবারের ক্রাইসিসের গল্প, তাই সকলের চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ। ইট্স নট জাস্ট আ থ্রিলার।
প্রশ্ন: ছবির মুক্তির সময়টাও জরুরি হয়ে যায়। কিছু দিন পরই ‘পাঠান’ মুক্তি পাবে, চিন্তা হচ্ছে না?
কৌশিক: ওই ছবির সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না। যাঁরা ‘পাঠান’ দেখবেন, তাঁরা ‘কাবেরী...’ দেখবেন না, তা তো নয়। প্রথম দিকে হয়তো আমরা সে ভাবে সিঙ্গল স্ক্রিনগুলো পাব না। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স তো পাব। সেখান থেকেই তো অনেকটা ব্যবসা হয়। যাঁরা ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ বা ‘দৃষ্টিকোণ’ দেখেছেন, সেই দর্শক নিশ্চয়ই আমাদের ছবি দেখবেন। বরং যাঁরা ‘পাঠান’ দেখতে আসছেন, তাঁরা হলে এসে আমাদের স্ট্যান্ডিটা দেখে আমাদের ছবিও দেখবেন (হাসি)।
প্রশ্ন: কৌশিক, আপনার সেটে অভিনেতা প্রসেনজিৎ ঠিক কতটা সিনসিয়ার?
কৌশিক: আমাদের বোঝাপড়াটা অন্য রকম। যখন থেকে আমি বুম্বাদাকে একটা সিন বলে দিই, ও নিজের মতো করে সেটার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। একদম চুপচাপ নিজের মতো করে ছবি হয় আমাদের সেটে। অনেক সময় আমি বুম্বাদার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি যে সাজেশনটা ঠিক পছন্দ হয়নি। তখন আমি বলি, ‘‘আচ্ছা তুমি নিজের মতো করে করো না।’’ শট দিয়েও অনেক সময় হোটেলে ফিরে বুম্বাদা ফোন করে বলছে, ‘‘দ্যাখ একটু, কাল যদি আরও এক বার শটটা নেওয়া যায়।’’ এতটাই খুঁতখুঁতানি থাকে।
প্রসেনজিৎ: এটা আমি বলব আশীর্বাদ যে আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, সব পরিচালকই আমার সঙ্গে খুব সহযোগিতা করেছে। কৌশিক-সৃজিত-অতনু অভিনেতা হিসাবে আমায় নিয়ে সবচেয়ে ভাঙাচোরা করেছে। আমি ওদের যথেষ্ট বুঝি, ওরাও তাই। আমাদের পার্টনারশিপগুলো দর্শকের ভাল লাগার একটা বড় কারণ হল, আমাদের মধ্যে কোনও রকম ইগো থাকে না। আমাদের লক্ষ্য একটাই— একটা ভাল ছবি করা। ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ আমার জন্য কতটা ঝুঁকির একটা ছবি ছিল ভাবুন তো! ঋত্বিক (চক্রবর্তী) যে মাপের অভিনেতা ইন্ডাস্ট্রির অন্য কোনও স্টার ওর সঙ্গে ওই ছবিটা করতেই চাইত না। ওর মতো অভিনেতা ভারতবর্ষে খুব কম আছে। সেখানে আমি তো করেছি কাজটা। দেড়-দু’ঘণ্টা ধরে সব টেকনিশিয়ানদের বাইরে বার করে আমরা রিহার্সাল দিয়েছিলাম। তার পর শুট হয়ে গেল দিব্যি!
কৌশিক: দু’দিন ছিল শিডিউলটা। তার পর রাত ১১টা শেষ!
প্রসেনজিৎ: আসলে আমার ঋত্বিকের প্রতি এবং আমার প্রতি ঋত্বিকের একটা শ্রদ্ধা-ভালবাসা আছে, তাই ছবিটা হয়েছিল। এই ছবিতে (‘কাবেরী...’) কৌশিক নিজে অভিনয় করেছে। ও একজন মারাত্মক অভিনেতা। পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি আর অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলির মধ্যে বিস্তর ফারাক। কিন্তু আমরা কখনও এখানে ভাবি না, যে কোনও দৃশ্য আমি একাই উড়িয়ে দিয়ে চলে যাব। দৃশ্যটা কার, ছবির লাভ কিসে হবে, সেইটুকু বোঝার বোধশক্তি আমাদের আছে।
কৌশিক: সব গোল তো মেসি করে না। মেসির অ্যাসিস্ট থাকে অনেক। সেটা খুব জরুরি। আমাদের ভাল সিনগুলো কিন্তু বুম্বাদার অ্যাসিস্ট করা। ঠিক সময় পা-টা বাড়িয়েছে বলে আমরা নেটে বলটা ঢোকাতে পেরেছি। সেই তালমিলটা খুব জরুরি।
প্রসেনজিৎ: আমি বার বার বলি ভাল অভিনেতা হতে গেলে, এক জন দক্ষ টেকনিশিয়ানের মতো ভাবতে হবে।
কৌশিক: ‘কাবেরী...’তে কিন্তু বুম্বাদা অনেকটা অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টরের কাজও করেছে।
প্রসেনজিৎ: আমি বিশেষ করে কৌশিক-সৃজিত-অতনুদের ছবিতে এ ভাবে কাজ করি। অনেক সময় ওরা জানেই না, আমি এডি-দের ডেকে হয়তো বললাম, ‘‘এই দু’জন আর্টিস্টকে রেডি রাখ তো। এর পর এই দু’টো সিন মারব আমরা।’’ ওরা হয়তো হাঁ হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘‘ওটা হবে?’’ আমি বললাম, ‘‘হবে, দু’ঘণ্টা সময় আছে। তুই শুধু রে়ডি রাখ।’’ আমি কিন্তু ডিস্টার্ব করি না। যেই সিনটা ওকে হয়ে যায়, তখন কানে কানে গিয়ে পরিচালককে বলি, ‘‘আচ্ছা এই দৃশ্যটা বাকি আছে, একটু করে নিই না।’’
কৌশিক: এমনও হয়েছে যে আমি প্যাক আপ করে দিয়েছি, কিন্তু বুম্বাদা যায়নি, অপেক্ষা করছে আমি ডাকব। জানত যে আমি সিনটা আবার নিতে পারি। কী করে জানে এগুলি বুঝি না। কিন্তু ঠিক বসে থাকে!
প্রসেনজিৎ: আসলে পরিচালক-অভিনেতাকে একে অপরের মনটা বুঝতে হবে। আমায় ঋতু (ঋতুপর্ণ ঘোষ) বলেছিল। যখন ‘দোসর’ করছি, তখন তিন-চার-পাঁচ শিফ্টেও কাজ হতো। আমায় হয়তো জিজ্ঞেস করল, ‘‘তোর কত ক্ষণ লাগবে বল তো?’’ আমি গড়গড় করে বলে দিতাম কী কী সিন আছে। ঋতু আমায় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তুই কবে শুটিং করেছিস, তোর এত সিন মনে আছে?’’
কৌশিক: হ্যাঁ, এটা বুম্বাদার একটা অদ্ভুত গুণ। এক বার ছবি করে নিলে সব মনে থাকে। পুরো কম্পিউটারের মতো।
প্রসেনজিৎ: পুরোটা মাথার মধ্যে থাকে আসলে (হাসি)।
প্রশ্ন: ঋতুপর্ণের কথা মাঝেমাঝেই আপনাদের কথাবার্তায় উঠে আসে নিশ্চয়ই?
প্রসেনজিৎ: অজস্র বার। যে হেতু আমরা দু’জনেই এত ঘনিষ্ঠ ছিলাম।
কৌশিক: যে কোনও আড্ডায়, বাড়িতে-শুটিংয়ে ওর কথা উঠবেই।
প্রসেনজিৎ: আসলে ওকে নিয়ে মজার গল্পও তো অনেক আছে। কাজের বাইরেও হাসির খোরাক জোগানোর প্রচুর উপাদান ছিল ঋতুর।
কৌশিক: বুম্বাদা আর ঋতুদার সঙ্গে আড্ডা মারাটা কিন্তু দু’টো দু’রকম একদম। বুম্বাদা সিনেমা ছাড়া কিছু নিয়ে কথা বলে না। ঋতুদার আড্ডাটা যেন ফিল্ম পত্রিকার গসিপ কলমের মতো। দুনিয়ার লোকে কী করেছে, কেন করেছে, আসলে কী করতে চেয়েছিল— যাবতীয় খবর থাকত।
প্রশ্ন: তৃষাণজিৎ বড় হচ্ছে। মুম্বই হলে কর্ণ জোহর এত দিনে একটা ছবি ভেবে ফেলতেন লঞ্চের জন্য। কৌশিক, আপনি সেই ভূমিকাটা নিচ্ছেন নাকি?
প্রসেনজিৎ: তৃষাণজিৎ এখনও অনেক ছোট (হাসি)।
কৌশিক: বুম্বাদা কিন্তু জানে যে, আমরা সময় হলে ঠিক একটা কিছু তৈরি করে ফেলব। এটা তো একটা বৃহৎ পরিবারের মতো। আমাদের বাচ্চারা সব মিলেমিশে থাকে। আমরা জানি যখন যাকে দরকার, আমরা ঠিক ডেকে নিতে পারব।