এক দাঙ্গার রাতের গল্প ‘ধর্মযুদ্ধ’
সিনেমা দেখার আগেই সেই সিনেমা নিয়ে মাঝেমাঝে কিছু ধারণা তৈরি হয়ে যায়। রাজ চক্রবর্তীর নতুন সিনেমা দেখতে যাচ্ছি, গতকালের টাটকা রিলিজ। ছবির নাম ধর্মযুদ্ধ। বেশ রমরমে স্টার কাস্ট, শুভশ্রী গঙ্গপাধ্যায়, পার্নো মিত্র, সোহম চক্রবর্তী আর ঋত্বিক চক্রবর্তী। মন বলছে, ফাটাফাটি একটি ফুলটস এন্টারটেইনমেন্ট দেখতে চলেছি; ঝাড়পিট, নাচ-গান, স্মার্ট ডায়লগ আর সবশেষে ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফেরা। যাকে বলে এক ঘর একখান ‘কমার্শিয়াল ব্লকবাস্টার’। পপকর্ন আর ঠান্ডা পানীয় নিয়ে হলে ঢুকলাম। হাসি হাসি মুখে তৈরি আমি, তৈরি বাকি দর্শকরাও। হলের আলো নিভল আর হঠাৎ অন্ধকার ফালি করে টলতে টলতে বেরিয়ে এল একটা বাস, তার সারা গায়ে দাউদাউ আগুন, তার নিস্তার নেই। কিছু মশাল হাতে ছুটে আসা উন্মত্ত মানুষ। দাঙ্গা লেগেছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। মফস্সলি জনবসতি জ্বলছে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কান্নার রোল। ছোট-বড় দল, কেউ খোলা তলোয়ার, তো কেউ খাঁড়া নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর, এক কোপে কেটে ফেলতে দু’সেকেন্ড সময় নিচ্ছে না এক অপরকে। পপকর্ন খেতে ভুলে গেছি আমি, ঠান্ডা পানীয় জুড়িয়ে জল। এ রকম তো কথা ছিল না! মূলধারার ছবি এরকমও হচ্ছে তাহলে, এই বাংলাবাজারে! ‘ধর্মযুদ্ধ’ গিলে ফেলছে তার দর্শকদের, হল একেবারে স্তব্ধ, প্রথম দৃশ্য থেকেই!
এক দাঙ্গার রাতের গল্প ‘ধর্মযুদ্ধ’, প্রেক্ষাপট আমাদের দেশের যে কোনও আধা মফস্সলি জায়গা, কারণ এই রাত এ দেশের যে কোনও জায়গাতেই যখন তখন নেমে আসতে পারে। এখানেই এক হাভেলির বুড়ি মালকিন, অভিনয়ে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, তার ঘরদোর আগলে রয়ে গিয়েছেন। জায়গাটা আর ভাল নেই, এ বার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত বললে, বুড়ি আধা হিন্দি আধা বাংলায় জবাব দেয়— ‘কেন যাবে! আমার দাদা-পরদাদার ভিটে আছে!’ এই বুড়ি লোডশেডিং-এ দুটো লণ্ঠন আর দুটো ব্যাটারি আলো জ্বালিয়ে ছেলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বসে। তার সঙ্গে আছে শবনম, পার্ণো মিত্র, যে এই বুড়িকে ‘আম্মি’ বলে ডাকে। এলাকায় হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ছে দাঙ্গা আর এর মধ্যেই হঠাৎ হাভেলির তোরণে এলোপাথাড়ি ধাক্কা, একটি মেয়ের কান্না শোনা যায় যেন। ‘আম্মি’ লণ্ঠন নিয়ে তোরণ খুলতে ছোটে, শবনমের হাজার বারণ সত্ত্বেও। ভরা পোয়াতি হিন্দু মেয়ে মুন্নি, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, কোনও রকমে দাঁড়িয়ে। সিঁদুর ঘামে লেপ্টে গেছে কপালে। ব্যথা ওঠায় ওর অটোচালক স্বামী বউকে নিয়ে হাসপাতাল যাবে বলে বেরিয়েছিল। পথে দাঙ্গাবাজদের হামলা। বউ আর তখনও ওই অদ্ভুত পৃথিবীর আলো না দেখা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য ওদের একটু নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে অটো নিয়ে ছেলেটি অন্য দিকে চলে যায়, তার পেছনে রে রে করে ধাওয়া করে হাতে খোলা তলোয়ার দাঙ্গাবাজ দল।
‘আম্মি’র ভিটেতে আশ্রয় পায় মুন্নিও। এ ভাবেই ওই রাতে ‘আম্মি’র হাভেলিতে প্রাণ বাঁচাতে এসে জোটে আরও দুটি চরিত্র, এলাকার পুরনো মাংসওয়ালা বা কসাই— জব্বর, অভিনয়ে সোহম চক্রবর্তী, আর গেরুয়া পাগড়ি বাঁধা রাঘব, ঋত্বিক চক্রবর্তী। এরা একজন মুসলমান লিগের সদস্য আরেক জন সংঘী। একই ছাদের তলায় এই চার অনাত্মীয়, পরস্পরবিরোধী, ভিন্ ধর্মের চরিত্র আর তাদের খুব চেনা অথচ হাড়হিম করা জীবনের গল্প ফুটে ওঠে একটু একটু করে। ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে একটি নিকষ রাতের গল্প, সাধারণ কিছু মানুষের গল্প যাদের স্বপ্ন বা জীবনের কাছ থেকে চাহিদা হয়তো শুধুই ভালবাসার মানুষটির সঙ্গে ঘর বাঁধা বা স্বামী-সন্তান নিয়ে একটা হাসিখুশি সংসার পাতা, বাপের পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখা অথবা বুড়ো মা-কে নিয়ে শান্তিমনে বেঁচে থাকা, ‘ধর্মযুদ্ধ’ এমন এক নারীর গল্প যার জাত, ধর্ম, ভাষা কী আমরা জানি না! যাকে কোন ধর্ম জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়, “তুমি হিন্দু হলে আমি মুসলমান আছি, তুমি মুসলমান হলে আমি হিন্দু আছি!” খাঁড়া হাতে এক দল গেরুয়াধারী যখন তার কাছে এসে ভিন্ ধর্মের মেয়েটিকে বের করে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে, এই বুড়ি অনায়াসে মিথ্যে বলে, “সে তো নেই, সে তো চলে গেছে কিছু দিন আগেই।” তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি কে?”, সে বলে “ঔরত”; যখন জিজ্ঞেস করা হয়, “তোমার কোন ধর্ম?” সে উত্তর দেয়, “ইনসানিয়ত।” তাকে কেউ মা বলে, কেউ আম্মি, কেউ দাদি। সে নিজের সবকটা রুটি তুলে দেয় এই অদ্ভুত লোকগুলোর মুখে যারা শিখেছে একে অন্যকে ঘৃণা করতে। এই লাঠি হাতে নড়বড়ে মা রুখে দাঁড়ায় সেই সব মানুষের সামনে যারা হিংস্রতাকে পেশা করে নিয়েছে! এই “মা”, এই “আম্মি” কি আমাদের দেশ? ওই আমাদেরই পোড়া দেশ যে মুখ বুজে আগলে রেখেছে তার সব ছেলেমেয়েকে, যে বারবার তাদের মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যে স্মিতমুখে সহ্য করছে সব আঘাত, যন্ত্রণা, ক্ষত অথচ তাকে কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে না, “হেই মা, তুই কেমন আছিস?” ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’কে মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির’ মা-কে। একা একা অন্ধকার রাতে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে আসে ক্লান্ত, বুড়ি আম্মি, বিড়বিড় করে মির্জা ঘালিব, “কুছ ইস তারাহ মেয়নে জিন্দগি কো/ আসান কর লিয়া/ কিসিসে মাফি মাঙ্গ লি/ কিসিকো মাফ কর দিয়া।”
‘ধর্মযু্দ্ধ’ এবং ‘ধর্মযু্দ্ধ’র নির্মাতা আমাকে স্রেফ বোকা বানিয়ে ছাড়ল। এই ছবিতে ঝাড়পিট আছে, গান আছে, ডায়লগবাজিও আছে কিন্তু এই সব কিছু জড়িয়ে এবং ছাপিয়ে আছে একটি আশ্চর্য রাত যা আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে মিলেমিশে যায়। রাজ একটি ফ্রেম-টু-ফ্রেম সৎ, শৈল্পিক এবং প্রয়োজনীয় সিনেমা বানিয়েছেন। এমন একটি সিনেমা যার চরিত্ররা জ্যান্ত হয়ে ওঠে আর তাদের আনন্দ, ভালবাসা, রাগ, অসহায়তা, অপরাধবোধ একটি স্বচ্ছ আয়নার মতো তুলে ধরে দর্শকের সামনে! রাজ চক্রবর্তীর ছবির দর্শককে বলা চলে ‘মাস’ এবং এই ছবিটি যে ‘মাস’-এর কাছে পৌঁছনো একান্তই দরকার! সহজ করে অসম্ভব দরকারি কিছু কথা রাজ বলেছেন এই ছবিতে। সুন্দর করে ফিরিয়ে এনেছেন মানুষের প্রতি মানুষের সহজাত বিশ্বাস, ভ্রাতৃত্ববোধ।
ভারতবর্ষের পঁচাত্তর বছরের স্বাধীনতার প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে, বিশ্রী এক জাতীয়তাবাদের আবহাওয়া হজম করতে করতে যখন ‘ধর্মযু্দ্ধ’ দেখলাম, গর্ব হল বেশ। সাবাসি যে কাকে দেব আর কাকে দেব না বুঝে উঠতে পারছি না অবশ্য। রাজ চক্রবর্তীকে কুর্নিশ। বললে বাহুল্য হবে না, নিজেকে অতিক্রম করে গিয়েছেন তিনি। তার আগামী কাজের অপেক্ষায় থাকলাম। চিত্রনাট্য এই ছবির নায়ক, তার সাধুবাদ প্রাপ্য পদ্মনাভ দাশগুপ্তর। শুধু মাত্র লণ্ঠন আর এমার্জেন্সি লাইটের আলো-ছায়ায় ছবির সিংহভাগ বুনে তুলেছেন সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার, যা এক কথায় অনবদ্য। ছবিটির প্রায় প্রত্যেক জন কলাকুশলী, চরিত্র ছোট হোক বা বড়, সাবলীল। এর মধ্যেও বিশেষ করে ভাল লাগে সপ্তর্ষি মৌলিক, কৌশিক রায়ের অভিনয়। একটি মাত্র দৃশ্য অথচ মনে থেকে যাবেই রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর দাপুটে অভিনয়।
শুভশ্রী আবার চমকে দিয়েছেন। ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা মুন্নির দাঙ্গার আগুনের প্রেক্ষাপটে হেঁটে আসাটুকুতেই স্রেফ মাত করে দিয়েছেন তিনি। চরিত্র আঁকড়ে কাজ করেছেন। তেমনই চাবুকের মতো অভিনয় পার্ণো মিত্রের। শবনমের চরিত্রটির অনেকগুলি শেড আর সবকটিতেই পার্নো দারুণ। সোহমও জোরদার টক্কর দিয়েছেন, মানিয়েওছে তাকে ঈষৎ বোকাসোকা ভালমানুষ হুট করে রেগে যাওয়া জব্বর খানের চরিত্র। ঋত্বিক চক্রবর্তীর মূল হাতিয়ার তাঁর আন্ডার-অ্যাক্টিং। চরিত্র যেমনই হোক— কাঁদুক, রেগে যাক, খুন করুক ঋত্বিক তাকে এমন এক আধারে পেশ করেন যা একদম অন্য রকম। আমার খুব ভাল লেগেছে ছবিতে মিশে থাকা এক নিটোল ‘হিউমার’-এর ছোঁওয়া রোজকার সাধারণ জীবনের অন্তঃসলিলা মজাটুকু। সবশেষে তাঁর কথাই বলব যে কি না জাহাজের মাস্তুল। যখন তিনি নেই, তখন তার অসুস্থ শরীরে অভিনয় করা এই চরিত্র দেখে আমার এটাই বারবার মনে হয়েছে স্বাতীলেখার অভিনয় কেন আমরা নিংড়ে নিইনি এই এতগুলো বছরে! ‘ঘরে বাইরে’ আর ‘ধর্মযুদ্ধ’-এর মাঝখানের এই ফাঁক কেন ভরে ওঠেনি তার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া নানা রকম চরিত্রের অভিনয়ে? কোথাও স্বাতীলেখা যেন ‘ধর্মযুদ্ধ’-র সেই চরিত্র যাকে সবাই ‘আম্মি’ নামে জানে, এবং একটি দেশের প্রতিভূ হয়েই থেকে গেলেন তিনি আমাদের উদাসীনতার জন্য!
শুধু একটাই কথা! ছবির নাম আমার পছন্দ হয়নি। বড় একমাত্রিক নাম ‘ধর্মযুদ্ধ’, ছবির সঙ্গে একটু যেন বেমানান। নাম নিয়ে আরেকটু ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন ছিল অবশ্যই।
ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফেরা হল না, রাজ। বেশ গর্বিত একটি মন নিয়ে ফিরলাম বাড়ি, মনে হল এ তো ‘মাস’-এর ছবি, ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র আর হয়তো চারাগাছ পুঁতে দেবে জাতীয়তাবাদ বিরোধিতার, শুভ বুদ্ধির, শুভ বোধের... ভালবাসার।