Rituparna ghosh

একটা সময় ঋতুপর্ণর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, লিখলেন দেবশ্রী রায়

ঋতু ভারি অদ্ভুত! নিমন্ত্রণ বাড়িতে আচমকা ডেকে বলল, ‘তুই কি আমার ছবিতে কাজ করবি?'

Advertisement
দেবশ্রী রায়
দেবশ্রী রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২১ ১৩:০৪
‘ঋতু বরাবরই ভারি অদ্ভুত, অন্য রকম।’

‘ঋতু বরাবরই ভারি অদ্ভুত, অন্য রকম।’

প্রত্যেক ৩১ অগস্টে ভাবি, মেঘপিওনের হাতে ঋতুকে (ঋতুপর্ণ ঘোষ) একটা চিঠি পাঠাব। ভাবাটাই সার। হয়ে আর ওঠে না। দুম করে এমন নাগালের বাইরে চলে গেল! চাইলেও আর নাগাল মেলে না। আরও আশ্চর্যের কথা, প্রতি বছর ওর জন্মদিনে আমার জন্মদিনের কথা মনে পড়ে। কেন? এক বার ঋতুর একটা ছবির শ্যুটে আমার জন্মদিন পড়েছিল। আমি বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটে আমি, রিনাদি (অপর্ণা সেন), ঋতু এবং আরও কয়েক জন মিলে খুব হইচই করেছিলাম। খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। ঋতুপর্ণ ঘোষ আজও দেবশ্রী রায়ের কাছে তাই ফেলে আসা এক মুঠো রঙিন দিন। যে দিনগুলোর গায়ে হুল্লোড়ের ঝলমলে রাংতা জড়ানো। ঋতু মানে আমার গয়না হারানোর দিন। আমার আর ঋতুর মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মান-অভিমানের দিন। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই অভিমান ভুলে, ‘‘এই চল চল, নে নে’’ বলে কাজে মেতে ওঠার দিন।

ঋতু বরাবরই ভারি অদ্ভুত, অন্য রকম। টিটোদা মানে দীপঙ্কর দে-র মেয়ের বিয়েতে আমি গিয়েছি। নিমন্ত্রণ বাড়িতে আচমকা ডেকে বলল, ‘‘তুই কি আমার ছবিতে কাজ করবি?’’ আমি অবাক। অচেনা কে এ ভাবে এসে সরাসরি ‘তুই’ সম্বোধন করে অভিনয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে! আমিও পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম, কাজ করব মানে? তখন ঋতু বলল, ‘‘আমি রিনাদিকে বলেছি। মা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে একটা ছবি করব। রিনাদি মা, তুই মেয়ে।’’ সেই অপরিচিতকে প্রথম দিনেই আমিও ‘তুই’ সম্বোধন করেই জবাব দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘‘ঠিক আছে শোনাস। দেখি, যদি পছন্দ হয়।’’ ব্যস, যোগাযোগ নম্বর আদানপ্রদান হল।

চিত্রনাট্য শুনলাম। যে ধারার ছবি করে এসেছি, তার থেকে একেবারে অন্য রকম। রিনাদির সঙ্গেও কথা বললাম। রিনাদি জানালেন, তিনিও এই ছবির সহ প্রযোজক। ‘উনিশে এপ্রিল’-এর ভিত এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল। যার তিন প্রযোজকের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি ‘আর’। ঋতু, রিনাদি, রেণু রায়। তত দিনে আমার টলিউডের তাবড় পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করা হয়ে গিয়েছে। অজয় কর থেকে বিভূতি লাহা হয়ে তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, অসিত সেন, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন। তার পরেও একেবারে নতুন এক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে করতে মনে হয়েছিল, ঋতু অনেক দূর যাবে। ওর প্রচণ্ড প্রতিভা। অন্য রকম ভাবতে জানে। ‘উনিশে এপ্রিল’ নিয়ে আমিও তাই অনেক আশা করেছিলাম। বিশ্বাস জন্মেছিল, এই ছবি অন্য ধারার ছবির জগৎ খুলে দেবে। হলও তাই। ছবিটি জাতীয় পুরস্কার পেল। আমি সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পেলাম।

Advertisement
‘যাঁরা ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনা এবং অভিনয়, দুটোরই অনুরাগী তাঁদের কাছে বড় সমস্যা তাঁর যে কোনও একটি সত্তাকে বেছে নেওয়া।’

‘যাঁরা ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনা এবং অভিনয়, দুটোরই অনুরাগী তাঁদের কাছে বড় সমস্যা তাঁর যে কোনও একটি সত্তাকে বেছে নেওয়া।’

আসলে ঋতু মানুষটাই অন্য রকম। নইলে সরাসরি অচেনা কেউ কাউকে ও ভাবে ‘তুই’ সম্বোধন করতে পারে? পরে শুনেছি, রিনাদিও ওকে ভরসা দিয়েছিল। বলেছিল, ‘‘ছবির বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারিস।’’ ওই জন্য বিয়েবাড়িতেই ঋতু আমায় ধরে পড়েছিল। এই মানুষটিই কাজের বেলায় অসম্ভব নিয়মনিষ্ঠ। সেখানে কোনও ছাড় নেই। তবে যখন যার সঙ্গে কাজ করত, তখনই তার সঙ্গে একটা অনায়াস সম্পর্ক তৈরি করে নিত। যাতে কথা বা ভাবের আদানপ্রদানে কোনও অসুবিধে না হয়। আমার সঙ্গেই তো প্রথম দিন থেকে ভাল বন্ধুত্ব তৈরি করে ফেলল। ও বকলে আমিও বকতাম। তার পর আবার সব ঠিক হয়ে যেত। তার মধ্যেই বুঝেছি, ঋতু বড্ড অভিমানী। ও রাগত কম। অভিমান করত বেশি। তাই হয়তো কষ্টও পেত বেশি। আর অভিমান হলেই মুখ ফিরিয়ে নিত। গলা ভার হয়ে আসত। অস্ফুটে বলত, ‘‘তুই কেন এমন করলি?’’ আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে হাল্কা করে দিতাম, ‘‘নে আমার হয়ে গিয়েছে। চল, আবার আমরা শুরু করি।’’

যাঁরা ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনা এবং অভিনয়, দুটোরই অনুরাগী তাঁদের কাছে বড় সমস্যা তাঁর যে কোনও একটি সত্তাকে বেছে নেওয়া। অনেকে আমাকেই প্রশ্ন করেছেন, কোনটা বেশি ভাল, কোনটা বেশি জোরালো ঋতুর? আমি বলব, ভাগ্যিস ঋতু অভিনয় জানত। তাই আমাদের অত সুন্দর করে চরিত্র বুঝিয়ে দিতে পারত। সমস্ত পরিচালক অভিনেতা হলে অভিনেতাদের বড় সুবিধে হয়। কী রকম? যেমন, তপন সিংহ। দুর্ধর্ষ অভিনেতা। পুরো একটা দৃশ্য অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘‘দেবশ্রী তুমি তোমার মতো করে করো। তুমি অভিনেত্রী। জানি, আমার থেকেও ভাল করবে।’’ তরুণ মজুমদার আবার হাতেকলমে শেখানোয় বিশ্বাসী। তেমনি ঋতু বলে দিত,‘‘এটা এ ভাবে কর। তা হলেই ঠিকঠাক আসবে।’’

যার সঙ্গে প্রথম দিন থেকে আমার তুই-তোকারি, সেই ঋতুর জীবনের শেষ দিনগুলো আমার কাছে বড্ড ঝাপসা। এক সঙ্গে ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘অসুখ’ করার পর আমাদের বন্ধনটা আরও জোরালো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঋতু ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওকে ঘিরে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভিড়। আমি বরাবর নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করি। তাই আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এক সময় দেখলাম, ঋতু অনেক দূরে চলে গিয়েছে। তখন কি ঋতুর মধ্যেও বদল ঘটছিল? বিশ্বাস করুন, সত্যিই কিচ্ছু জানি না। তবে লোকমুখে শুনেছি, শেষের দিকে ঋতু নাকি নিজেকে নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। অনেক কাটাছেঁড়া করেছিল। নিজেকে পরতে পরতে পাল্টে নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল। সত্যি-মিথ্যে জানার চেষ্টা করিনি। কারণ, ঋতু আমার অভিনয় জীবনে সত্যিই ‘ঋতুবদল’ ঘটিয়েছিল। মান-অভিমানে, বন্ধু্ত্বে, কাজের প্রতি ভালবাসায়, ছক ভাঙা ভাবনায় সত্যিই ও অন্য রকম।

আমার কাছে আমার ঋতু সেই বদলের সঙ্গী হয়েই থাক।

Advertisement
আরও পড়ুন