জয় মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
অ্যাকশন হিরো হিসেবে বাংলা ছবিতে আত্মপ্রকাশ। সহ-অভিনেত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক। রাজনীতি থেকে শুরু করে পরবর্তী জীবনে একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়া। বড় পর্দার পর ছোট পর্দার সঙ্গে দূরত্ব। কেমন আছেন অভিনেতা জয় মুখোপাধ্যায়? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
সম্প্রতি এক সকালে ফোনে পাওয়া গেল জয়কে। আড়াই বছর আগে ‘বিক্রম বেতাল’ ধারাবাহিকে দেখা গিয়েছিল জয়কে। দীর্ঘ বিরতি কেন? জয় অবশ্য এই সময়কালকে ‘বিরতি’ হিসেবে দেখছেন না। বললেন, ‘‘বাংলাদেশে ‘রঙ্গনা’ নামে একটা ছবির শুটিং করছি। এ ছাড়াও বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ়ের কথাও চলছে।’’
২০০৯ সালে ‘লক্ষ্যভেদ’ ছবির মাধ্যমে টলিউডে পা রাখেন জয়। তার পর ‘টার্গেট’, ‘মনে পড়ে আজও সেই দিন’, ‘অস্ত্র’ ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘আমি যে কে তোমার’ মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। ৭ বছর তাঁর কাছে কি কোনও ছবির প্রস্তাবই আসেনি? জয় বললেন, ‘‘ভাল প্রস্তাব আসেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলা ছবি এবং ইন্ডাস্ট্রিও অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তাই সময় নিয়েছি।’’ টলিপাড়ায় কাজের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকের দিকটিতেও আলোকপাত করতে চাইলেন জয়। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৩-১৪ নাগাদ যে পারিশ্রমিকে আমি কাজ করেছি, এখন সেটা দেওয়া হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু তার থেকেও কম অফার করা হলে তো মুশকিল! নতুনেরা রাজি হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, আমার পক্ষে সেটা সমস্যা। আমাদেরও তো সংসার আছে!’’
এক জন অভিনেতার সারা সপ্তাহের অনেকটা সময়ই শুটিংয়ের মধ্যে কাটে। জয় এখন সেখানে সময় কাটাতে শরীরচর্চায় মন দিয়েছেন। পাশাপাশি, নিয়মিত দেশ-বিদেশের ভাল ছবি দেখে চর্চায় থাকতে চাইছেন তিনি। বললেন, ‘‘মাঝে লিগামেন্টে চোটের জন্য বিরতি নিই। কিন্তু, আমি আবার ছবি করতে চাই। নিজের ফিটনেসে সময় দিচ্ছি।’’
অভিনয় থেকে দূরে থাকেন বলে মনের মধ্যে হতাশা কাজ করে। কিন্তু তিনি যে ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূরে রয়েছেন তা মানতে নারাজ জয়। বললেন, ‘‘‘সিসিএল’ খেলার সময় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। ইন্ডাস্ট্রির কোনও পার্টিতে গেলেও সকলের সঙ্গে দেখা হয়।’’ জয় বিশ্বাস করেন, নিয়মিত কাজের মধ্যে থাকলে মানুষকে নিয়ে চর্চা হয়। প্রচারে থাকলে তখন অভিনেতা হিসেবে তাঁরও যে অনেক কিছু বলার থাকবে, সে কথাও জানিয়ে দিলেন তিনি।
ইন্ডাস্ট্রিতে জয়ের কাজ হারানোর নেপথ্যে কিন্তু অন্য কথা শোনা যায়। এক সময় প্রাক্তন বান্ধবী অভিনেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছিলেন তিনি। প্রয়াত অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মাকে শুটিং ফ্লোরে চড় মারারও অভিযোগ ওঠে। ফলস্বরূপ ‘জিয়নকাঠি’ ধারাবাহিক থেকে বাদ পড়েন তিনি। নিন্দকেরা বলেন, মাথাগরম এবং রাগের কারণেই ক্রমশ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে জয়ের। সময় পেরিয়ে এখন হয়তো জয়ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিছুটা হতাশ হয়েই বললেন, ‘‘কারও নামের সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে গেলে কোনও প্রযোজকই তখন তাঁর সঙ্গে কাজ করতে রাজি হন না। যা রটে, তার কিছুটা হলেও বটে। কিন্তু সবাইকে মানানো কঠিন ছিল। আর জনে জনে গিয়ে আমি বলতে পারিনি, আমাকে কাজ দিন।’’
জয় কি ইন্ডাস্ট্রির গোষ্ঠী রাজনীতির শিকার? প্রশ্নের উত্তর এল কিছুটা অন্য ভাবে। জয়ের মতে, প্রত্যেক ইন্ডাস্ট্রিতেই ‘রাজনীতি’ থাকে। কিন্তু তাঁর কাজ না পাওয়ার নেপথ্যে সে রকম কোনও কারণ নেই বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। জয়ের কথায়, ‘‘বিনোদন জগতে ৩০ শতাংশ পরিশ্রম। বাকিটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। ইন্ডাস্ট্রিতে রাজনীতি থাকলে এ রকমও তো হতে পারে যে, কোনও সময়ে আমি তার সুবিধা পেয়েছি। হাতে কাজ নেই বলেই ‘রাজনীতির শিকার’ বলব না!’’
তবে কঠিন সময়েও যে প্রযোজকেরা তাঁর পাশে ছিলেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না জয়। আগেই জানালেন নিসপাল সিংহ রানের কথা। জয়ের কথায়, ‘‘রানেদা তার পরেও আমার উপরে বিশ্বাস রেখেছেন। কাজ করতে গিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি।’’ মাঝে যিশু সেনগুপ্ত প্রযোজিত একটি ধারাবাহিকেও জয়ের কাজের কথা ছিল। অভিনেতা বললেন, ‘‘যিশুদাও মজা করে জানতে চেয়েছিলেন যে, মাথাগরম করে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করব না তো! তবে ওই কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়নি।’’
সম্প্রতি বরাহনগর উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে বিধায়ক হয়েছেন সায়ন্তিকা। তাঁকে কি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জয়? অভিনেতা হেসে বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে ওর কোনও রকম যোগাযোগ নেই।’’ তবে অভিনেত্রীর কাজ সম্পর্কে জয় খোঁজখবর রাখেন। বললেন, ‘‘একসময়ে আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম, একসঙ্গে কাজও করেছি। ওর কেরিয়ারের জন্য আমার তরফে শুভেচ্ছা রইল।’’
জয়ের সমসাময়িক ইন্ডাস্ট্রির অনেক তারকাই এখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন। এক সময় বাবার (ধনঞ্জয় মুখোপাধ্যায়) পথে জয়ও বিজেপিতে যোগ দেন। তবে জানালেন, এই মুহূর্তে রাজনীতির থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তিনি। জয় বললেন, ‘‘রাজনীতিতে পা রেখে বুঝেছিলাম, অভিনয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। পাশাপাশি, দর্শক তাঁদের মতো একটা ইমেজ তৈরি করে নেন। সেটা আমি চাইনি।’’
বাবার মৃত্যুর পর ২০১৮ সাল থেকে কলকাতা ছেড়ে উত্তরপাড়ার বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন জয়। মা, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়েই তাঁর পরিবার। জয়ের কথায়, ‘‘২১ বছর বয়সে অভিনয় শুরু করি। পরিবারকে ছেড়ে অনেক দিন বাইরে থাকতে হত। এখন নতুন করে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পেরে আমার নিজেরই খুব ভাল লাগে।’’
নতুন কাজের ক্ষেত্রে কোনও রকম আপস করতে নারাজ জয়। তাঁর কথায়, ‘‘যে ছবি করে নিজে ফোন করে মানুষকে জানাতে হবে, সেখানে অভিনয় করতে চাই না! এখনও আমার কাজ সম্পর্কে মানুষের ধারণা রয়েছে। সেটা নষ্ট করতে চাই না।’’
‘ভুল’ শুধরে নিতে চাইছেন জয়। বিশ্বাস করেন, তিনি হারিয়ে যাননি। নিজেকে আরও এক বার প্রমাণ করতে উদ্যোগী তিনি। সমাজমাধ্যমে এখনও অনুরাগীদের তরফে নতুন কাজের প্রশ্ন তাঁর কাছে অনুপ্রেরণা। ইন্ডাস্ট্রির নির্মাতা এবং অনুরাগীদের উদ্দেশে তাঁর একটাই বার্তা, ‘‘প্রত্যেকের জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া উচিত। সুযোগ পেলে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই। আমি নিশ্চিত, তাঁরা আবার আমার কাজ পছন্দ করবেন।’’