পরীমণি। ছবি: ফেসবুক।
ঘড়ি ধরে ৬টায় পৌঁছে গিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। ঢাকা থেকে এক বিশেষ কাজে তিনি চুপিচুপি এসেছেন। তাঁর নাগাল পাওয়া কঠিন। কোথাও আসছেন শোনা গেলেও দেখা যায়, তিনি সেখানে নেই। আবার কোথাও তাঁর আসার সম্ভাবনা না থাকলেও দেখা যায়, তিনি হাজির। আলিয়া ভট্ট বা ক্যাটরিনা কইফও যা করেন না, তা-ই করেন তিনি। তিনি পরীমণি।
দেখা হল কলকাতায়। সাক্ষাৎকার দেবেন না বলে শুরু করলেন জীবনের কথা। ছেলের খাবার তৈরি করতে করতে খুঁজছিলেন বেগনি রঙের শাড়ি। ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়ায়াতেই জড়িয়ে নিলেন সাদা সুতির শাড়ি। পাড় জুড়ে হাতে আঁকা বেগনি রঙের লতা-পাতা।
প্রশ্ন: সাদা শাড়ি কেন?
পরীমণি: এই সাদা শাড়িতে আমার বাংলাদেশ আছে। আর যে বেগনি রং খুঁজছিলাম, তার একটু ঝলকও আছে। একটু গাঢ় রং অনেক কিছুকে দমিয়ে দেয়।
প্রশ্ন: আপনি তো চান সকলকে দমিয়ে রাখতে…
পরীমণি: না, আমি আমাকে নিয়ে বলতে চাই। তার জন্য কে কে দমে যায়, আমি জানি না।
প্রশ্ন: আপনি খুব খামখেয়ালি...
পরীমণি: না। আমি একেবারেই খামখেয়ালি নই। আমাকে সহজে ধরা যায়। বরং যারা খামখেয়ালি, তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারি না। আমি কাজকে প্রাধান্য দিতে চাই। আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা জানেন, আমাকে বুঝে কাজ করতে হয়।
প্রশ্ন: এখন যেমন আপনার ছেলে পদ্ম আছে, এটা বুঝে সবাই আপনাকে কাজ দিচ্ছে?
পরীমণি: একদম তাই। খুব ভয়ে থাকি। কাজ হাতে নিলে মনে হয়, সব ঠিক করে করতে হবে। আমি যখন অভিনয় করছি, তখন পদ্ম যদি ‘আম্মা’ বলে ওঠে, তা হলে আমি চরিত্রের মধ্যে থাকতে পারব কি?
প্রশ্ন: কী করেন তখন?
পরীমণি: তখন ‘কাট’ হবে। ওই সময় ওর তো শুধু আমাকেই দরকার। সেই জায়গা কেউ নিতে পারবে না। ‘কাট’ থেকে আবার চরিত্রে ফিরব। দেখুন, আমার উপরে কেউ মাতৃত্ববোধ চাপিয়ে দেয়নি। আমি বাচ্চা চেয়েছিলাম। বাবুকে সময় দেব, কাজও করব। এখন এটাই চাই। বলা সহজ। করা খুব কঠিন।
প্রশ্ন: ছেলেকে তো কাজে নিয়ে যান...
পরীমণি: হ্যাঁ। নিয়ে যেতে গিয়ে অদ্ভুত ঘটনা হল এক দিন। এত কিছু শুটিংয়ে দেখে ও... বাড়ি এসে দেখি, কেবল হাত গুটিয়ে মারার চেষ্টা করছে। মুখে আওয়াজ করছে। আমাদের বাড়ি এখন শান্ত বাড়ি। কেউ চিৎকার করে কথা বলে না। এগুলো বাবুর জন্যই সচেতন ভাবে করেছি। এখন তো যা দেখবে, তা-ই শিখবে। কিন্তু শুটিংয়ে মারামারিটাই শিখল! যে ছেলে খেলনার দোকানে গিয়ে কোনও দিন বন্দুক চায়নি, সে-ও মারামারিটাই শিখল। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: মাঝে কলকাতায় এসেছিলেন, পদ্ম তখন অসুস্থ, আপনি একাই সব সামলেছিলেন।
পরীমণি: আমার ছেলে। আর কে সামলাবে?
প্রশ্ন: কিন্তু পদ্ম সুস্থ হওয়ার পরে সমাজমাধ্যমে আপনার প্রাক্তন স্বামী শরিফুল রাজ আপনাদের ছেলের নাম লিখে একটা ভালবাসার চিহ্ন এঁকেছিলেন...
পরীমণি: হ্যাঁ। ওই ভালবাসার চিহ্ন না দিলে তো আমার ছেলে সুস্থই হত না! ( হেসে উঠলেন)।
প্রশ্ন: প্রাক্তন স্বামী রাজ ছেলে পদ্মের কতটা দায়িত্ব নেন?
পরীমণি: এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি এই প্রথম দিচ্ছি। বিষয়টা ব্যক্তিগত হলেও সকলের জানা দরকার। কোনও ভুল করুণা নিয়ে আমি বা আমার ছেলে বাঁচতে চাই না। যে বাচ্চাকে দেখবে না, অথচ বলে বেড়াবে, “বাচ্চা আমার”, তাকে আমি ছাড়ব না। যারা মা তারা বুঝতে পারবে, কোন জায়গা থেকে আমি এই কথা বলছি। এ পর্যন্ত বাচ্চার বাবা আমার বাচ্চার একটাও খোঁজখবর নেয়নি।
প্রশ্ন: সে কী!
পরীমণি: আরে! আমার বাচ্চার খোঁজ কেন নেবে? আমার বাচ্চার সব দায়িত্ব প্রথম থেকে আমি নিয়েছি। আমি আর ওই নামটাই উচ্চারণ করতে চাই না। ওই নামের সঙ্গে রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ছাড়া কিছুই নেই আর। ভালবাসা, সম্মান তো দূরের কথা! রাগ থেকে খেপে গিয়ে একটা কথা বললে সেই মানুষই অসম্মানিত হবে। যে মানুষ আমার বাচ্চার বাবা, তাকে অসম্মান করব না। কিন্তু যতটুকু অসম্মান তার প্রাপ্তি, সেটুকু আমিই করব, সেটুকু থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে না কেউ।
প্রশ্ন: পরীমনি মানেই বিতর্ক, কী করে নিজেকে নেতিবাচক মন্তব্য থেকে বাঁচিয়ে রাখেন?
পরীমণি: প্রচুর মানুষের ভালবাসা পাই। আমি জেলফেরত। যে ভাবে মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, সেটা সচরাচর কেউ পায় না। যখন জেল থেকে বেরোচ্ছি, আমার দর্শকরা চিৎকার করে বলছে, “তোমায় কেউ গুলি করুক, আমরা সামনে দাঁড়িয়ে যাব।’’ আমি কাজ না করলে তারা এত ভালবাসত না।
প্রশ্ন: আপনি সব কাজেই কি সফল?
পরীমণি: না। আপনি বলতে পারেন, আমার অনেক কাজ সফল হয়নি। ‘ফ্লপ’ হয়েছে। কিন্তু আমার নামটা হয়ে গিয়েছে। তার জন্যও আমি দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রথম কাজ থেকেই পরীমণি নামটা প্রতিষ্ঠিত। সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ। ফেরেস্তার মতো বাচ্চাও আল্লাহ দিয়েছেন আমায়।
প্রশ্ন: আপনার একমাত্র অভিভাবক, আপনার নানু চলে গেলেন...
পরীমণি: নানু আমার সব ছিল। আল্লাহ কিছু দিলে, কিছু নিয়েও যান। বাচ্চা এল, যা একান্ত আমার। অন্য কারওর ভাগ নেই।
প্রশ্ন: আনন্দবাজার অনলাইনের ‘বছরের বেস্ট’ অনুষ্ঠানে আপনি বলেছিলেন, জেলে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনি বই লিখছেন।
পরীমণি: লেখা তো শেষ। জেলের অভিজ্ঞতা লিখেছি। সুন্দর শিক্ষা পেয়েছি জেলে গিয়ে।
প্রশ্ন: মনে হয়, এটা তো ষড়যন্ত্র…
পরীমণি: মনে হওয়ার কিছু নেই। এটা তো ষড়যন্ত্রই। আমি খুন করিনি, বোমা রাখিনি, জঙ্গি হামলায় যুক্ত নই। তা-ও জেলে যেতে হল? তবে এর বেশি এখন বলব না।
প্রশ্ন: বিষয়টা তুলতে চান না?
পরীমণি: না। কেন জেলে গেলাম? কী হল? কখনও কোথাও বলিনি। যেমন ছেলের বাবাকে নিয়েও অনেক অনেক কথা বলিনি। বলব। দুটোই ঘটা করে পরে বলব।
প্রশ্ন: কলকাতায় কী করছেন? সেটা তো বলবেন?
পরীমণি: কলকাতায় কাজ করতে চাই। আমার কাছে দুই বাংলা এক।
প্রশ্ন: এখানকার কোন অভিনেত্রীদের ভাল লাগে?
পরীমণি: ঋতুদি (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত), শ্রাবন্তীদি (শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়), শুভশ্রীদি ( শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়)। কার নাম বলব, আর কার নাম বলব না!
প্রশ্ন: বাংলাদেশে আপনার জন্য নাকি ১০টা ছবি আটকে আছে?
পরীমণি: (একটু বিচলিত না হয়ে) ৭টা। নতুন ছবিও করছি।
প্রশ্ন: নতুন কী ছবি?
পরীমণি: ‘ডোডোর গল্প’। আমার বাবুর চেয়েও ছোট বাচ্চার মা। এই চরিত্রের জন্য আমায় ৭ কেজি ওজন বাড়াতে হয়েছে।
প্রশ্ন: ব্যক্তিজীবন, না কি ইন্ডাস্ট্রি, পরীমণির লড়াই কোথায়?
পরীমণি: ব্যক্তিজীবন। এখন জানি, মানুষ কী পছন্দ করে। আগে জানতাম না।
প্রশ্ন: কী জানলেন?
পরীমণি: গলা তুলে কথা বলা যাবে না। সমাজ চায়, তার তৈরি নিয়মে সবাই চলবে। আমি সেটা করতে চাইনি।
প্রশ্ন: প্রেম করতে চান?
পরীমণি: না। লিখে দিচ্ছি, পরী আর প্রেম করবে না। নিজেকে ভালবাসতে শুরু করেছি। ছেলেকে নিয়ে শান্তিতে ঘুমোই। “শুটিং শেষ ৯টায়। তুমি রাত এগারোটায় কেন ফিরলে?” এই প্রশ্ন আর চাই না। এক সময় প্রশ্নের উত্তরে ইউনিটের লোকের ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করে নিতে বলতাম। এর চেয়ে বেশি অপমান আর কী হতে পারে? এই অপমান আর কত দিন? নিজের পথ নিজে খুঁজে নেওয়াই ভাল। প্রবল ভাবে বাঁচব…