অর্ণ মুখোপাধ্যায়, সোহিনী সরকার এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য ফাইল চিত্র।
গোলাপি পাঞ্জাবি, সাদা পাজামায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। দৃপ্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ সন্দীপের। পাশে অনুজ্জ্বল অথচ শান্ত, নম্র নিখিলেশ। বন্ধুকে সে এই প্রথম বাড়িতে আনছে, বিমলার সঙ্গে দেখা করাতে। হঠাৎ কী মনে হতে ঘুরে দাঁড়াল সন্দীপ। সহাস্যে অনির্বাণ ভট্টাচার্য হয়ে উঠে বললেন, “আমার একটা আইডিয়া আছে! নিখিলেশকে একটু পারফিউম লাগিয়ে দিই? বন্ধু আফটার অল!” দর্শকাসন থেকে পরিচালক অর্পিতা ঘোষের জবাব, “হ্যাঁ, দে না!” নিখিলেশ ওরফে অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের কানের দু’পাশে আতর লাগিয়ে তাকে নিয়ে মঞ্চে ঢুকল ‘ঘরে বাইরে’-র সন্দীপ।
রবীন্দ্রনাথের নাটক নয়। উপন্যাস। তা নিয়ে সত্যজিৎ রায় এক বার ছবি করেছেন। বছর কয়েক আগে করেছেন অপর্ণা সেনও। ফের কেন নাটক হয়ে আসছে ‘ঘরে বাইরে’? নতুন কী বলতে? তারই খোঁজে আনন্দবাজার অনলাইন পৌঁছে গিয়েছিল মধুসূদন মঞ্চে, পঞ্চম বৈদিকের নতুন নাটকের মহলায়। বেরিয়ে এল মঞ্চের নিখিলেশ, বিমলা ও সন্দীপের আত্মকথন। সঙ্গে পরিচালকের ভাবনাও।
নিখিলেশ
শ্যুটিংয়ের ক্লান্তি চোখে-মুখে নিয়েই অর্ণ মুখোপাধ্যায় উঠে পড়েছেন মঞ্চে। এখনও ভাল করে সংলাপ মুখস্থ করার সময় পাননি। তবু রবীন্দ্রনাথের নিখিলেশ হয়ে ওঠা কি এতটাই সোজা? ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’-এর অভিনেতা বলেন, “সত্যি বলতে কি, নিখিলেশ চরিত্রের প্রস্তুতি আমি এখনও নিতে পারিনি। খুঁজে যাচ্ছি নিখিলেশকে। যে অনন্ত কথা বলে, তার কথার ভিতরে একটা যাপন আছে। আমরা বলি তো অনেক কথাই, কিন্তু সেটাকে প্রয়োগ করতে পারি না। আমি বলছি না আমি দুর্নীতিপরায়ণ, তবু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ধাঁচের মানুষের পক্ষে নিখিলেশকে ধরা কঠিন। অতিমাত্রায় সক্রিয়, জমিদারি দেখে, ঘর সামলায়— নিখিলেশই সব। সমাজটা যে একটা অবক্ষয়ের দিকে চলে যাবে এবং নীতি, মূল্যবোধ, সততা, স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলবে, তা মেনে নেবে না নিখিলেশ। হারবে তবু বিচ্যুত হবে না। তার অনন্ত অপেক্ষা। রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চেয়েছেন, কোথাও নিখিলেশের পথেই চলা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা বোধহয় কল্পলোক। ১০০ বছর পরেও অপেক্ষাটা একই। দেশের কথা বলতে বলতে সন্দীপ প্রেমের জালে পড়ে। নিখিলেশ বরং দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাদা, সবুজ, লালের মধ্যে লালটাকেই আগে চোখে পড়ে, যেমন সন্দীপ। কিন্তু নিখিলেশ সাদা, তাকে দেখতে পেতে হয়।”
বিমলা
কী ভাবে স্বদেশীর যুগের ‘মক্ষীরানি’ হয়ে উঠছেন তিনি? সোহিনী সরকারের কথায়, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনিতেই বিমলাকে এমন ভাবে নির্মাণ করেছেন, সেটা অনুসরণ করলেই কোথাও পৌঁছে যাওয়া যায়। তা ছাড়া থিয়েটারের মজা হল, লেন্সবন্দি তো হয়ে যাচ্ছে না একেবারে। রিহার্সালগুলোয় একটু একটু করে রপ্ত করা যায়। তার উপর অর্ণ আর অনির্বাণের মতো দু’জন অসাধারণ সহ-অভিনেতা। আর অর্পিতাদি তো আছেনই। এটা একটা বাড়ি তৈরির মতো ব্যাপার। মানে শুরুতেই বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি তা নয়, কিন্তু মাথায় আছে কেমন হবে। পশ্চিমবঙ্গে এখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে ‘ঘরে বাইরে’ ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। বিমলা সাধারণ মানুষের মতো দিশাহীন। সে এক বার নিখিলেশের ভাবাদর্শে মুগ্ধ হয়ে সেটাকেই জগৎ মনে করে। আবার যখন সন্দীপকে দেখে, তার দেহসৌষ্ঠব, বাচনভঙ্গি, বাগ্মিতায় আকৃষ্ট হয়। আবার পরে গিয়ে বুঝতে পারে, নিখিলেশ আলাদা, তার নীতিই ঠিক ছিল। ঠিক যেমন অবস্থা জনসাধারণের। যদি নিখিলেশের মতো আদর্শবান মানুষ থাকত, তা হলে ভারতবর্ষের রূপটা আলাদা হত।”
সন্দীপ
এ যুগের সন্দীপের আত্মকথন কেমন হতে পারে? অনির্বাণ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “এ যুগের সন্দীপ এ যুগে থাকবে না। সন্দীপ একেবারেই রবীন্দ্রনাথের সন্দীপ। রবীন্দ্রনাথের সন্দীপে অনেকগুলো অনুসন্ধানী মুহূর্ত আছে, যেখানে সে নিজের আদর্শকে প্রশ্ন করে। যেহেতু এটা একটা উপন্যাস এবং আমরা এটাকে থিয়েটার করছি, তার কাজটাই হল একটা মানুষের চরিত্রের সবক’টা দিক মঞ্চে তুলে ধরা। এ যুগের সন্দীপদের আত্মকথন তো আমরা শুনতে পাই না। কারণ, সেটা যদি কোনও ভাবে বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাদের রাজনৈতিক চেহারাটাই ভেঙে পড়বে। মানুষ তো খুব একটা দ্বন্দ্ব বা দ্বান্দ্বিক অবস্থান পছন্দ করে না। তাই এই সন্দীপের অবস্থান আমাদের সমাজে বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আছে বলে আমার মনে হয় না। কখনও মনে হতে পারে, সন্দীপ ঠিকই তো বলছে। প্রবৃত্তি দ্বারাই তো পরিচালিত হব। কিন্তু নিখিলেশ যখন বলবে, তা হলে আর মানুষ উন্নত প্রাণী হল কিসে? তখন মনে হয় সেটাও ঠিক।”
পরিচালক
মঞ্চের ‘ঘরে বাইরে’-র দ্বন্দ্বটা চারিয়ে যাক, এমনটাই তো চান অর্পিতা ঘোষ। তাঁর ভাবনাই যে এই নাটকে আলাদা চরিত্র হিসাবে কাজ করছে, সেটা স্পষ্ট। বললেন, “আমি যে ভাবে নাটকটাকে দেখছি, তাতে সন্দীপ আর নিখিলেশ দুটো ধারণা। আর বিমলা হল আমজনতা। মানুষ পপুলিস্টিক আইডিয়ার দিকে বেশি ঝোঁকে, যার হোতা হল সন্দীপ। বিমলাও সে দিকে আকৃষ্ট হয়। কিন্ত রবীন্দ্রনাথও মনে করেছেন, পপুলিস্টিক রাজনীতি কোথাও পৌঁছবে না। আর এটাই ভারতবর্ষের চেহারা। প্রাক্-স্বাধীনতা থেকে আমরা এ দিকেই এগিয়েছি। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেও এক সময় হিংসা ঢুকে পড়েছিল। গান্ধীজীর হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল সবটা। সেই সময়টাকে ধরতে চাইছি। কারণ, এখনকার রাজনৈতিক বাতাবরণে আমরা সত্যিটা চিনতে ব্যর্থ হচ্ছি। সেই সত্যি হয়ে সামনে আসছে নিখিলেশ। নিখিলেশ বলছে, আমার কাজ এখনই শেষ হবে না, দেরি হবে। কিন্তু মানুষ দেরি চায় না, চটজলদি ফল পেতে চায়। এই যে এখনই চাই-এর প্রবণতা, ‘ঘরে বাইরে’ নাটকের মধ্যে দিয়ে মনে করাতে চাইছি যে, তাতে ভাল কিছু পাওয়া যায় না। কষ্ট করতে হয়। কষ্ট না করলে দাঙ্গা লাগবে, হিন্দু-মুসলিম কাটাকাটি, মারামারি করবে। এ যুগের নিখিলেশ, বিমলা, সন্দীপ কথাগুলো মানুষকে আর একবার মনে করিয়ে দিক— সেই আশাতেই এই নাটক।’’
পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনায় আগামী ২২ অগস্ট, একাডেমিতে মঞ্চস্থ হবে 'ঘরে বাইরে'।