Suman Banerjee

Suman Banerjee: তুমি বিজেপির লোক, আমায় ছোঁবে না, শুনতে হয়েছিল সহ-অভিনেতার কাছে: সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়

বহু বছর ধরেই বাংলা ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ। সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় ঝাঁপি খুললেন আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে।

Advertisement
পরমা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২২ ১৩:৪৮
বহু বছর ধরেই বাংলা ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়।

বহু বছর ধরেই বাংলা ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়।

কখনও নায়কের ভাল দাদা কিংবা ভীষণ ভাল বন্ধু। কখনও বা গল্পের দুষ্টু লোক। বহু বছর ধরেই বাংলা ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়। ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞতা থেকে ব্যক্তি জীবন— সবটাই মেলে ধরলেন আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে।

ধারাবাহিকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে, তবে মুখ্য ভূমিকায় নয়। খারাপ লাগে না?

Advertisement

আমি যখন পরপর ধারাবাহিকের নায়ক হতাম, তখনও বলিষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা থাকতেন এ রকম চরিত্রে। এখন আমি সেই জায়গায়। এখন গল্পের প্রধান চরিত্র না হলেও অন্যতম প্রধান চরিত্র আসে আমার কাছে। তবে হ্যাঁ ইদানীং টেলিপাড়ার নতুন ধারা বলছে, পুরনো, বয়স্ক অভিনেতাদের কেন্দ্র করে ধারাবাহিক হচ্ছে। আশা করি, আমিও তেমন ধারাবাহিকে মুখ্য চরিত্র পাব।


অভিনয়ে আসা কী ভাবে?

অভিনয়ের প্রতি কিন্তু আমার টান ছিল না। শুরু করেছিলাম ক্যামেরার পিছনে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। তখন চ্যানেল বলতে শুধু দূরদর্শন। ‘রূপকথা’ বলে একটা ধারাবাহিকে শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু। তার পরে ছ’বছর দেবুদা, মনোজ স্বামী, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিন্দম দে, সুবীর মুখোপাধ্যায়, শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়দের সহকারী ছিলাম। আমার অভিনয়ে আসা কিন্তু একটা মজার ঘটনা। মোটরবাইকে যাতায়াত করতাম। দূরদর্শনের ‘মোহিনী’ ধারাবাহিকের শ্যুটে আমার হেলমেট ব্যবহার হয়েছিল। সেটা ফেরত আনতে গেলে পরিচালক মিলন রায়চৌধুরী আমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কলেজে পড়ি, টাকার দরকার। রাজি হয়ে যাই। প্রথম দৃশ্যেই অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, লাবণি সরকারদের মতো সিনিয়রদের সঙ্গে। আঠাশ-উনত্রিশটা এনজি দিয়ে ঘাবড়ে-টাবড়ে একাকার! তার পরে ‘স্বপ্ননীল’ করলাম। জনপ্রিয়ও হল সেই ধারাবাহিক। তার পরে ‘ভুল ঠিকানায়’, ‘জন্মভূমি’। আর ফিরে তাকাতে হয়নি।


এই মুহূর্তে কী কাজ করছেন?

আপাতত শুধু ‘মোহর’-এই। ‘এরই নাম কড়ি খেলা’র আমার চরিত্রের পাট শেষ। এ ছাড়া, দুটো ছবিতে কাজ করছি। একটা ইতিবাচক, অন্যটা নেতিবাচক চরিত্র। তবে যেহেতু শ্যুটিং চলছে, তাই এর বেশি কিছু বলব না এ নিয়ে।


ধারাবাহিকে ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক চরিত্র, কোনটা বেশি পছন্দের?

ইতিবাচক এবং নেতিবাচক, দুই ধরনের চরিত্রই আমি পাই, তাতে দর্শক আমায় পছন্দও করেন। এটাকে আশীর্বাদ বলেই মনে করি। চরিত্রটা ভাল হলে, সংলাপ ভাল হলে যে কোনওটাই ভাল। তবে ব্যক্তিগত ভাবে খল চরিত্রে কাজ করতে বেশি ভালবাসি। তাতে অভিনয়ের সুযোগও বেশি, চ্যালেঞ্জও বেশি। নায়কের দাদা, বন্ধুর মতো ভাল চরিত্রে তো আসলে সবটাই ভাল ভাল— স্তর বা শেড কম।


আর ছবিতে? সেখানে কেমন চরিত্র পছন্দ?

যা পাব, যেমন পাব। তবে বড় ছবির ছোট্ট চরিত্রের চেয়ে ছোট ছবির বড় চরিত্রে কাজ করা বেশি পছন্দের। আমি যে সময়ে শুরু করেছি, তাতে তখনকার বেশির ভাগ পরিচালকের বাণিজ্যিক ছবিতেই কাজ পেয়েছি। নায়কও হয়েছি অন্তত আঠাশটা ছবিতে। সেগুলো আঠাশ দিনও চলেনি, সেটা অন্য প্রশ্ন। তরুণ মজুমদারের ছবিতেও ডাক এসেছিল। কিন্তু ওঁরা যে পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে রাজি হওয়া সম্ভব ছিল না। জানি, এ কথাটার জন্য হয়তো অনেকে আমার উপর ক্ষুণ্ণ হবেন। তবে এটাই বাস্তব। পারিশ্রমিক যথাযথ না হলে কাজ করব কী করে?

সপরিবার  সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়।

সপরিবার সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়।

অন্য ধারার ছবির যুগ এখন। তাতে কাজ করছেন?

অন্য ধারার ছবিতে অভিনয় করতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন জানি না, কেউ কখনও এমন ছবিতে আমায় ডাকেননি। এই একটা আফশোসের জায়গা আমার। আমারও ভাল পরিচালক, ভাল অভিনেতা, ভাল প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছে করে। রাজ চক্রবর্তীর ‘প্রেম আমার’-এ একটা চরিত্র করেছিলাম। সেই ছবি নিয়ে চর্চাও হয়েছে বিস্তর। তবে পরের কোনও ছবিতে রাজও আমায় আর ডাকেননি।


কার কার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছে করে?

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার আমার বড্ড শখ। সৃজিত মুখোপাধ্যায়, মৈনাক ভৌমিক, দেবালয় ভট্টাচার্য, ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়রা প্রত্যেকেই ভাল কাজ করছেন। এঁদের কারও ছবিতে সুযোগ পেলে ভাল লাগবে।


আর ওটিটি? সেখানে কাজ করতে ইচ্ছে করে না?

করেছি অল্পস্বল্প। ক্লিক প্ল্যাটফর্মের জন্য কাজ করলাম সদ্য। তবে হইচই-এর মতো বড় প্ল্যাটফর্ম থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রস্তাব আসেনি। সুযোগ এলে নিশ্চয়ই কাজ করব। আর হিন্দি ওটিটি থেকে কোনও ডাক আসেনি। এখনও অপেক্ষায় আছি। আশাও রাখি।


ওটিটিতে থ্রিলার না সেক্স কমেডি, কোনটায় কাজ করতে চান?

যা খুশি। অভিনয়টা তো এখন শুধু নেশা নয়। এটাই আমার পেশা। তাই যে কোনও চরিত্রেই আমি কাজ করতে রাজি। আমি বরাবরই পরিচালকের হাতের পুতুল। এখনও নরম মাটির তালের মতোই সেটে যাব। পরিচালক যেমন ভাবে গড়ে নিতে চাইবেন, সে ভাবেই চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলা আমার কাজ।

বলিউডে ‘পরিণীতা’ করেছেন। তার পর?

‘পরিণীতা’য় কিন্তু প্রথমে আমার চরিত্রটা অনেক বড় ছিল। সাতাশ-আঠাশটা পোশাক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কাজ শুরুর সাত দিন আগে প্রদীপ সরকার আমায় জানান, ছবি লম্বা হয়ে যাচ্ছে দেখে আমার অংশটা অনেকটাই বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে শুধু ক্যামিও হিসেবেই কাজ করি ছবিটায়। তার পরে ‘রোক সাকো তো রোক লো’-তে কাজ করার কথা ছিল। সেটাও হয়নি। আসলে বলিউড থেকে প্রস্তাব এসেছে বেশ কয়েক বার। কিন্তু কোনওটাই হয়ে ওঠেনি নানা কারণে। এখন আর বলিউডের প্রতি তেমন টান অনুভব করি না।

ভাল অভিনেতা আপনি। তা হলে লোকে ডাকছে না কেন? পিআর ভাল নয়?

না, সেটা সত্যিই একেবারে ভাল নয়। কোনও দিনই আমি কারও কাছে গিয়ে কাজ চাইতে পারি না। ম্যাজিক মোমেন্টসে প্রায় নব্বই শতাংশ ধারাবাহিকে আমার জন্য ভাল চরিত্র তোলা থেকে। ওঁদের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত। কিন্তু আজ অবধি লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বা শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নিজে থেকে কাজ চাইনি। সাংবাদিক বন্ধুদেরও কখনও বলিনি, আমার ওমুক খবরটা লিখে দেবে? ইগো নয় কিন্তু। আসলে ছোটবেলা থেকেই না শুনতে পারি না একেবারেই। আর এই ‘না’ শোনার ভয়ে কারও কাছে যেচে কাজ চাইতেও ভয় পাই।


আর প্রেমের ক্ষেত্রে? ‘না’ শোনার ভয় কাজ করেনি?

একেবারে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাকে বিয়ে করবে? আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই।’ ঝুঁকি নিয়েই বলা। তবে বিশ্বাস ছিল, না শুনতে হবে না!


এখন তো ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামও পরিচিতির হাতিয়ার। কাজে লাগান না?

নেটমাধ্যমে যেটুকু পোস্ট করি, নিজেই করি। কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে দায়িত্ব দিইনি। প্রোফাইলে ব্লু টিকের জন্য তদ্বিরও করিনি। রিল ভিডিয়ো বানাই, তাতে বড় জোর গানে ঠোঁট মেলানো। নানা দিক থেকে শ্যুট করে, এডিট করে সাজিয়েগুছিয়ে ভিডিয়ো তৈরি করা আর আমার দ্বারা হয় না। সময়, ইচ্ছে, সাহস কোনওটাই হয়ে ওঠেনি। এটা নিশ্চিত ভাবেই গাফিলতির জায়গা।


উইকিপেডিয়া পেজও তো নেই দেখছি?

ঠিক ঠিক, এটা আজই তৈরি করব (হাসি)। মজা করছি না, সত্যিই বলছি কিন্তু। এটা অন্তত করা উচিত। দরকারও।


টলিউডের পার্টিতে যান না? সেটাও তো জনসংযোগের জায়গা..

সত্যি কথা বলব? মুখোশ পরে মেকি কথাবার্তা, একই ধরনের আড্ডা-আলোচনা আর ভাল লাগে না। বহু বছর তো হল এ পাড়ায়। কাজ শেষ হলে সোজা বাড়ি! নিজের মতো সময় কাটাই। বই পড়ি, সিনেমা দেখি, লেখালেখি করি। বউ-ছেলের কাছে কিংবা নিজস্ব বন্ধুদের দলটার সঙ্গেই আমি অনেক বেশি সচ্ছন্দ। আগে পার্টিতে যাওয়ার ডাক আসত। যেতাম না। যাই না দেখে এখন আর পার্টি বা পুরস্কারের অনুষ্ঠানে কেউ ডাকেও না (হাসি)! তার জন্য আক্ষেপও নেই।

 সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়।

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিজেপির মুখ ছিলেন। পদ ছাড়তে হল কেন? কাজ পাচ্ছিলেন না?

না না, এটা অনেকে বলে বটে। তবে বিজেপি করার জন্য কাজ পেতে আমার অন্তত অসুবিধে হয়নি। একটা সময়ে রটে গিয়েছিল, আমি নাকি রাজনীতিটাই করব, অভিনয় ছেড়ে দিয়েছি। সেটা একেবারেই সত্যি নয়। ধারাবাহিকের ডাক এসেছে, আমি কাজও করেছি তাতে। এ দিকে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দলেও দায়িত্ব বাড়ছিল। ফলে কোনও দিকেই পুরো সময় বা গুরুত্ব দিতে পারছিলাম না। আর এটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। সে জন্যই পদ ছেড়েছি, যাতে নিজের পেশা, মানে অভিনয়টা মন দিয়ে করতে পারি।


টলিপাড়ায় দলাদলি আছে। বিজেপির সদস্য হিসেবে সহ-অভিনেতা বা অন্য কারও সঙ্গে কোনও সমস্যা হয়নি?

সে অভিজ্ঞতা আছে। উল্টোটাও আছে। আমাদের দুনিয়ায় কারও সঙ্গে দেখা হলে ভালবেসে জড়িয়ে ধরাটাই দস্তুর। এক জনকে তেমনই জড়িয়ে ধরতে গেলে বলেছিল, ‘তুমি বিজেপির লোক, আমাকে ছোঁবে না!’ আবার সৃজিত রায়, লীনাদি-শৈবালদা, রানেদা, ভরত কলের মতো বেশ কিছু মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ওঁরা কিন্তু ব্যক্তি সুমনকেই বরাবর গুরুত্ব দিয়েছেন। রাজনৈতিক মতের মিল বা অমিলকে নয়।


পর্দায় রাজন্যা মিত্রের সঙ্গে জুটি বেঁধেই আপনাকে দেখা যায় বেশি। সম্পর্ক কেমন?

খুবই ভাল। রাজন্যা খুব ভাল অভিনেত্রী। আমাদের সম্পর্কটাও সুন্দর। ফলে জুটির একটা রসায়ন তৈরি হয়ে গিয়েছে। পরপর ধারাবাহিকে সেটা দর্শক পছন্দও করেছেন। রাজন্যার সঙ্গে কাজ করতে আমার ভালও লাগে।


টলিপাড়ায় আর কার সঙ্গে এ রকম ভাল সম্পর্ক?

অনেকের সঙ্গেই। কণীনিকা, অরুণিমা, চান্দ্রেয়ী, মনামি, সমতা— এ রকম অনেকগুলো নাম আছে। আমরা বহু দিন একসঙ্গে কাজ করেছি। কণী আমায় ভাইফোঁটা দেয়। রাজন্যার সঙ্গেও দাদা-বোনের সম্পর্ক।


এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে, এত অভিনেত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক। প্রেমের গুজব রটেনি?

আগে রাগারাগি করতাম খুব, এখন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছি। গুজব রটলেও কিছু যাবে আসবে না। আদতে যা-ই হোক, জুটিতে বেশি কাজ করলে আগে গুজব রটতও। এখনও রটে, তবে সেগুলো কিন্তু বেশির ভাগই বানানো। অনেক ক্ষেত্রেই প্রচারের উদ্দেশ্যে। তবে ইন্ডাস্ট্রির মানসিকতা পাল্টেছে অনেক। আর নিজেরও বয়স বেড়েছে। প্রেমের গুজব-টুজব এখন অতীত। তা ছাড়া আমি তেরো বছর হল বিবাহিত, বউয়ের সঙ্গে তার আগেও প্রেম করেছি সাত বছর। কুড়ি বছর তো ওর সঙ্গেই কেটে গেল! গুজব রটে আর হবেই বা কী! (হাসি)

বাবাকে দেখে ছেলে অভিনয়ে আসতে চায়?

কাব্য, মানে আমার ছেলের বয়স দশ। ও নিজে নিজেই চিত্রনাট্য লেখে, সুর করে, বন্ধুদের নিয়ে নিজেই শ্যুট করে, এডিট করে। ছেলেমানুষ তো! সকালে ফুটবলার হতে চায়, বিকেলে অভিনেতা। বড় হোক। যা করতে ইচ্ছে করবে, তা-ই করবে।

Advertisement
আরও পড়ুন