কয়েদিদের নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ৬১টি শো করেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র
ওরা বহরমপুর সংশোধনাগারের বাসিন্দা। সেটুকুই তাঁর জানা। ২৪ জন কয়েদি কে কী অপরাধ করেছিল, সে সব খুঁজতে চাননি অভিনেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। কেবল পরিবার গড়তে শিখিয়েছিলেন তাদের। রবি ঠাকুরকে ঘিরে। কয়েদিরা সেই প্রথম বইয়ের পাতায় আগ্রহ ভরে চোখ বুলিয়েছিল। হাতে তুলে নিয়েছিল খাতা। সে খাতায় নাটকের দৃশ্য, সংলাপ লেখা। গরাদ ধরেই তার পরে উদাত্ত কণ্ঠে গান। নির্দেশনায় প্রদীপ।
কয়েদিদের নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ৬১টি শো করেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা। মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’, ‘তোতা কাহিনী’ এবং ‘রক্তকরবী’-র মতো নাটক। গত ১৫ বছরের নিরন্তর গবেষণা তাঁর নিজেরও সেরা সংগ্রাম বলেই মনে করেন ‘বেলাশুরু’ এবং ‘বেলাশেষে’-র 'গণশা'। বিষয় ছিল কারাগারে ‘থিয়েটার থেরাপি’।
সেই কবে রামকৃষ্ণ বলে গিয়েছেন, 'থিয়েটার করলে লোকশিক্ষে হয়।' সেই নীতিতেই কি এতগুলো বছর পার করলেন অভিনেতা? প্রদীপ নিজেকে কিন্তু নাট্যকর্মী নয়, ভালবাসেন সমাজকর্মী বলতেই।
কেবল দেড়-দু’ঘণ্টার বিনোদন নয়। নাটক যে মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, সে কথা প্রমাণ করে ছেড়েছেন প্রদীপ। কয়েদিদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন ৭০ বছরের থিয়েটার শিল্পী। নারী-পুরুষ কয়েদিদের একসঙ্গে এনে মহড়া দিয়েছেন। আইনি পথে যা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। কিন্তু তাঁর ইচ্ছের কাছেই নত হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। দিল্লিতে প্রধান বিচারপতি নিজে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন কয়েদিদের রবীন্দ্র-যাপন।
২০০৭-এ শুরু। দীর্ঘ ১৫ বছর থিয়েটার থেরাপির পরে এখন কিছুটা ঝাড়া হাত-পা প্রদীপ। কলকাতায় আসা-যাওয়া লেগেই থাকে। শহরে ঘর বাঁধার স্বপ্ন কোনও দিনই ছিল না অভিনেতার। বহরমপুরের এক কোণেই তাই রয়ে গিয়েছেন বর্ষীয়ান শিল্পী।
এ বার কী ভাবছেন? কয়েদি পরিবার ছেড়ে এসে কেমন কাটছে জীবন? প্রশ্ন রেখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রদীপ জানান, নতুন নাটক আছে তাঁর কাছে। কিন্তু করবে কে? তাঁর ক্ষোভ, অভিনেতারাও এখন বিভিন্ন দলের হয়ে খেপ খাটেন। আগের সেই একাগ্রতা কোথায়? নাটক বুঝে নাটক করার মানুষ কোথায়? তার চেয়ে তিনি এই বেশ ভাল আছেন। সরকারি চাকরির ভাতায় জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান কোনও মতে।
এত সাফল্য পেরিয়ে এসে কিসের এত ক্ষোভ? জিজ্ঞেস করতেই বিস্ফোরক প্রদীপ, ‘‘৪০ বছর থিয়েটার করার পর অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাল লাগত না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কথা বলছি, জীবনেও যদি সেগুলো অনুসরণ না করতে পারি, তা হলে আর নাটক করে লাভ কী! কিন্তু এখন রং আর ঝলমলে পোশাকেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে সব কিছু। মঞ্চ থেকে নেমে বিলাসী জীবনে মিশে যাওয়া। এ সব পারব না আমি।’’
কয়েদিদের কী ভাবে চিনিয়েছিলেন, বুঝিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে? শুনে ফের আবেগপ্রবণ প্রদীপ। বললেন, ‘‘ওরা ওদের মতো করে গড়ে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। ২২ শ্রাবণ এলে আমায় বলত, কেন বলেন লোকটা মরে গিয়েছে? এই তো রোজ বেঁচে আছে দেখি। সমাজের চোখে অপরাধী, যাকে আপনারা বলবেন ‘নষ্ট মানুষ’, তেমনই এক জন অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, রবীন্দ্রনাথ জেল খাটেননি কখনও? সত্যি? তা হলে ‘তাসের দেশ’ লিখলেন কী ভাবে? এ তো জেলের নাটক! ওদের যখন 'রক্তকরবী' করতে বললাম, তখনও বলেছিল এটা আমাদের নাটক।’’
প্রদীপ জানান, তাঁর গুরু রবীন্দ্রনাথ। তিনি কিছু করেননি, রবীন্দ্রনাথই পথ দেখিয়েছেন অপরাধীদের। সংশোধন করে দিয়েছেন। কারাবাস শেষ করে মূল স্রোতে ফিরে জীবনযাপন করছেন কয়েদিরা। বিয়ে করেছেন এমন দুই কয়েদি। তাঁদের এক জন হিন্দু, অন্য জন মুসলিম। ধর্মের বেড়া ভেঙে ঘর বেঁধেছেন। যমজ সন্তানও হয়েছে। ওদের নাতি বলেন প্রদীপ। নাম রেখেছেন ভানু আর রবি।
প্রদীপের দাবি, পুরস্কারের আশায় কোনও দিন বসে থাকেননি তিনি। জীবনের কাছে কোনও প্রত্যাশাও নেই। নিজে যা বুঝেছেন, সেটুকু সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে মঞ্চে উঠেছিলেন। সে প্রয়োজন যদি ফুরোয়, বহরমপুরের গ্রামেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন নিজের মতো করে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।