‘অমরসঙ্গী’ ছবির একটি দৃশ্যে (বাঁ দিকে) সোহিনী সরকার এবং বিক্রম চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
একসঙ্গে কাজ এই প্রথম। তবে বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। তাই সাক্ষাৎকার দিতে বসে দু’জনের রসায়ন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন ছবি ‘অমরসঙ্গী’র পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান পরিস্থিতি, কখনও আবার সম্পর্কের বিভিন্ন পরতে ঘোরাফেরা করলেন টলিপাড়ার নতুন জুটি সোহিনী সরকার এবং বিক্রম চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের কথা শুনল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশ্ন: আপনাদের দু’জনেরই এটা বছরের প্রথম ছবি। জুটি হিসেবেও প্রথম। মনের মধ্যে কী চলছে?
বিক্রম: নতুন ছবি মুক্তির আগে একটু টেনশন হয়। কারণ, অনেকটা ভালবাসা দিয়ে একটা ছবি তৈরি হয়। তাই ছবি মুক্তি পাওয়াটা আমার কাছে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের মতো। দেখা যাক, দর্শক কী বলেন।
সোহিনী: বিক্রমকে দেখে আমি মনে জোর পাই। কারণ, ছবি মুক্তির আগে আমার তো মনে হয় কেউ দেখতে আসবেন না!
প্রশ্ন: সে কী! ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় দু’দশক কাটিয়ে ফেলার পরেও এ রকম ভাবনা?
সোহিনী: আমার নাটকের শোয়ের সময়েও কিন্তু এ রকম মনে হয়। আবার কখনও কখনও মনে হয় যে, খুব ভাল হবে (হাসি)।
বিক্রম: তোর যখন যেটা মনে হয়, তখন কি সেটাই হয়?
সোহিনী: মন থেকে যেটা মনে হয়, সেটা অনেক সময়েই ঘটে কিন্তু।
প্রশ্ন: ‘অমরসঙ্গী’ নিয়ে আপনার মন কী বলছে?
সোহিনী: আমি কিছু বুঝতেই পারছি না। নিজে অভিনয় করেছি তো। তাই বেশি করে নেতিবাচক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে (হাসি)। বিক্রম তা-ও আমাদের জুটি নিয়ে ভাল ভাল কথা বলছে। আর আমার খালি মনে হচ্ছে, কোথায় কোথায় খুঁত রয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: তার মানে, আপনি আত্মবিশ্লেষণে বিশ্বাসী।
সোহিনী: প্রচণ্ড।
বিক্রম: আমিও কিন্তু ওর মতোই। কিন্তু বিশ্বাস করি, যে কাজটা করেছি, সেটা ভালই দাঁড়িয়েছে। ছবি মুক্তির আগে আমি নিজে থেকে একটু পরিবেশক বা হলমালিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। আমি কিন্তু আমাদের জুটি নিয়ে খুব ভাল প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি।
প্রশ্ন: এই ভালর মাঝেও একটা খারাপ রয়েছে। সম্প্রতি আপনাদের ছবির পোস্টার ছেঁড়া হল কেন? বিক্রম আপনি তো সমাজমাধ্যমে পোস্টও করেছিলেন।
বিক্রম: অতীতে বহু বাংলা ছবির সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। কে করেছে, কেন করেছে— এই সব বিষয়ের মধ্যে আমি ঢুকতেই চাই না। ছবির পোস্টার সাঁটতে প্রযোজকের একটা বড় অর্থ খরচ হয়। সেটা ছিঁড়ে ফেলা হল দেখে খারাপ লেগেছিল। পোস্টার না দেখতে পেলেও মানুষ যাতে ছবি মুক্তির খবর জানতে পারেন, তাই আমি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলাম।
সোহিনী: কোনও কাজকে মানুষ অবজ্ঞা করতেই পারেন। কিন্তু একটা ছবি না দেখেই তার প্রতি অশ্রদ্ধার এই প্রবণতা ভাল চোখে দেখি না।
প্রশ্ন: শুক্রবার আরও দুটো প্রযোজনা সংস্থা তাদের ছবি নিয়ে আসছে। আপনারা কি ষড়যন্ত্রের শিকার বলে মনে হয়?
বিক্রম: আবার বলছি, এর নেপথ্যে কে বা কারা আছে তা নিয়ে আমার কোনও রকম মাথাব্যথা নেই। একটা ঘটনা খারাপ লেগেছে। আমি আমার মতো প্রতিবাদ করেছি। তিনটে ছবিই যাতে দর্শক দেখেন, সেটাই চাই।
প্রশ্ন: তথাকথিত ‘ছোট’ ছবিকে কোণঠাসা করার প্রবণতা কি ইন্ডাসস্ট্রিতে বাড়ছে বলে মনে হয়?
বিক্রম: ‘অমরসঙ্গী’ ছোট ছবি নয় বলেই মনে করি। বিশ্বাস করতাম, ‘পারিয়া’ ছোট ছবি নয়। পুজো এবং বড়দিনে একসঙ্গে একাধিক ছবি মুক্তি পেয়েছে। বড় প্রযোজনা সংস্থা যে একটু বেশি শো পাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করব। দর্শক যে ছবি পছন্দ করবেন, সেটাই বেশি দিন প্রেক্ষাগৃহে থাকবে। তা ছাড়া, বাংলা ছবি সফল ভাবে চলাটা খুবই দরকার। তার ফলে ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকেই উপকৃত হবেন।
সোহিনী: আমি এই বিষয়গুলো খুব একটা বুঝি না। আগে ভাবতাম, একটা ছবিতে অভিনয় করেছি, মানুষ দেখবেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারি যে, শো পাওয়াটাও একটা লড়াই।
প্রশ্ন: নব্বই দশকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘অমরসঙ্গী’ ছবিটা দেখেছেন?
বিক্রম: অনেক পরে বাবার সঙ্গে বসে ভিসিআর-এ দেখেছিলাম (হাসি)।
সোহিনী: (একটু ভেবে) আমি টিভিতে দেখেছিলাম।
প্রশ্ন: দুটো ছবির নামের সাদৃশ্যের কারণেই কি ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রসেনজিৎকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন?
বিক্রম: বুম্বাদা আমাদের সব ইচ্ছেই পূর্ণ করেন। দাদার আশীর্বাদ চেয়েছিলাম। নতুন প্রজন্মের নতুন কাজে দাদা সব সময়েই পাশে থাকেন। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। আমি দাদার কাছে কৃতজ্ঞ।
সোহিনী: আমার প্রথম সুযোগ তো বুম্বাদার প্রয়োজনা সংস্থার ‘অদ্বিতীয়া’। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছবির কাজ শুরু করি। দাদার সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক।
প্রশ্ন: আপনারা দু’জনে পূর্বপরিচিত। কিন্তু প্রথম ছবিতে কাজের পর একে অপরের সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পেরেছেন?
সোহিনী: প্রোডাকশনের খুঁটিনাটি নিয়ে বিক্রমের উৎসাহ রয়েছে। ফ্লোরে খুবই সহজ মানুষ। পরিবারের প্রতি ও খুবই দায়িত্বশীল। ও নিজের চুলের স্টাইল নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে!
বিক্রম: (হেসে) আমার বদনাম হয়ে যাচ্ছে!
সোহিনী: ওর সম্পর্কে ইন্ডাস্ট্রির বন্ধুদের থেকে যে যে ভাল কথা শুনেছি, সেগুলো ফ্লোরে দেখতে পেয়েছি। সাবলীল অভিনেত্রী। ও না থাকলে হয়তো আমার চরিত্রটা এত ভাল ভাবে বেরিয়ে আসত না।
প্রশ্ন: একে অপরের এমন কোনও গুণ, যেটা গ্রহণ করতে চাইবেন?
বিক্রম: সোহিনী খুব সহজেই ফ্লোরে মিশে যেতে পারে। গরমের দিনে বাড়ির একটা ঘরে শুটিং। সময় বাঁচানোর জন্য পাশের ঘরেই সকলে বসতাম। দেখতাম, সোহিনীও কিন্তু সকলের সঙ্গেই সেখানে বসে থাকত।
সোহিনী: টাকাপয়সার বিষয়ে বিক্রম খুব বুদ্ধিমান। কত পারিশ্রমিক বলা উচিত, সেটা ও খুব ভাল জানে। মাঝেমধ্যেই কাজের ক্ষেত্রে আমি ওর থেকে পরামর্শ নিই, যে ঠিক কত টাকা চাওয়া উচিত (হাসি)।
বিক্রম: (হাসতে হাসতে) আমাকে এ বার সকলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে!
সোহিনী: আমি যেখান থেকে ৫ টাকা বার করে আনতে পারব, ও সেখান থেকে ১০ টাকা নিয়ে আসতে পারবে। তাই বিক্রম আমার ম্যানেজার হলে আমার খুব সুবিধা হবে (হাসি)।
বিক্রম: কিন্তু সেই ১০ টাকাটা যেন সঠিক প্রাপ্য হয়, সেটাও আমি দেখব।
প্রশ্ন: এই ছবিতে পুরনো প্রেম ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে। প্রাক্তনেরা কখনও জীবনে ফিরে এলে কী করা উচিত বলে মনে হয়?
সোহিনী: পুরনো কোনও কিছু আমি আঁকড়ে বাঁচতে পছন্দ করি না। যা গিয়েছে, তা যাক। যা হয়েছে, সেটা আমাদের দু’জনের জন্যই ভাল। দেখুন, কী কারণে বিচ্ছেদ হয়েছে, তার উপর নির্ভর করে বন্ধুত্ব থাকবে কি না। যেমন অনেকের সঙ্গেই আমার এখনও বন্ধুত্ব রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজও করি আমি।
বিক্রম: (অবাক হয়ে) সত্যি?
সোহিনী: কেন নয়! তিক্ততা ছিল না বলে সম্পর্কটাও রয়ে গিয়েছে। তাই আলাদা সম্পর্কে থেকেও আমরা এখনও গল্প করতে পারি। অসুবিধা হয় না। কিন্তু খুব তিক্ততা থেকে সম্পর্ক ভাঙলে, তাকে হয়তো ক্ষমা করতে পারব না। যদি পারি, তা হলে হয়তো ভবিষ্যতে কাজও করব।
বিক্রম: আমি কোনও সম্পর্কে তিক্ততায় বিশ্বাসী নই। কারণ এক সময় তার সঙ্গে আমি ভাল সময়ও কাটিয়েছি। আমার জীবনে নিশ্চয়ই তার একটা অবদানও রয়েছে। যে সময়টা একসঙ্গে কাটিয়েছি, সেটা তো সবটাই তাকে ঘিরে ছিল।
সোহিনী: সেটা তুই স্বীকার করছিস বলে ভাল লাগছে। কিন্তু বহু মানুষ আছে, যারা এটা স্বীকার করে না এবং সেখান থেকেই তিক্ততার সূত্রপাত ঘটে।
বিক্রম: এইটুকু জীবন। একটা মানুষের সঙ্গে ভাল সময় কাটিয়ে থাকলে পরবর্তী সময়ে কোথাও দেখা হলে একটু হেসে জিজ্ঞাসা করব না যে, কেমন আছিস!
সোহিনী: আর সে জিজ্ঞাসা করতে না চাইলে?
বিক্রম: তা হলে তো করব না। কারণ, আমি তখন বাধ্য।
সোহিনী: সেখানেই তো বিষয়টা বদলে যায়। আমার এক বন্ধু আছে, যার ইংরেজিটা খুবই ভাল। কাজের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হলে তাকে অনুবাদ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। সে করেও দিয়েছে। কারণ, আমার জার্নিতে তারও অবদান রয়েছে বলেই আমিও সেটা স্বীকার করে নিয়েছি। আর সেই বিষয়টা শোভনও (সোহিনীর স্বামী শোভন গঙ্গোপাধ্যায়) জানে। কিন্তু যাঁদের হয়তো সেই কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না...
বিক্রম: (সোহিনীকে থামিয়ে দিয়ে) সেই মানুষটাই হয়তো আমাদের জন্য সঠিক ছিল না। এটাও তো হতে পারে।
সোহিনী: একদম। এই ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না।
প্রশ্ন: আজকের সমাজে ‘অমরসঙ্গী’ কি জীবনে সত্যিই পাওয়া সম্ভব?
বিক্রম: কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করি, প্রেম এ রকমই হওয়া উচিত। দু’জনের প্রেম যদি শেষ না হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সেখানে এই পাগলামোটা থাকা উচিত।
সোহিনী: খুব অদ্ভুত প্রজন্মের সদস্য আমরা। ভাত খেয়ে স্কুলে যাওয়া, বিকেলে মাঠে খেলা। প্রেম করা শিখেছি ছবি দেখে। ছিল না কোনও মোবাইল। আমাদের মানসিকতা একটু পুরনো।
বিক্রম: মা মাসে এক দিন বাড়িতে কাস্টার্ড তৈরি করতেন। সেটা ছিল আমার কাছে একটা বড় উদ্যাপন।
সোহিনী: সেখান থেকে এই পেশা, প্রচারের আলো— বদলে গেল জীবন। এখন সবাই আগে কেরিয়ারকে আগে রাখে, প্রেম থাকে পরে। সম্পর্কে সময় দেয় না। তাই প্রত্যেকই আমরা একজন ‘অমরসঙ্গী’র সন্ধানে থাকি।
বিক্রম: একদমই তাই। ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ এবং ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ দেখে বড় হয়েছি। তাই জীবনের সঙ্গীটিও যেন ‘অমরসঙ্গী’ হয়— সেটাই তো চাইব।
প্রশ্ন: সোহিনী বিয়ের পর জীবন কতটা বদলাল?
সোহিনী: খুব একটা বুঝতে পারছি না। আগে একার জন্য কাজ করতাম। এখন দু’জনের জন্য ভেবে কাজ করতে হয়। ফলে আমার আর শোভনের মধ্যে দায়িত্বগুলোও একটু ভাগ হয়ে গিয়েছে। খুব কম দিনের আলাপে আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই এখনও আলাপ-পরিচয়, নিজেদের আবিষ্কার করার অপেক্ষায় রয়েছি।
প্রশ্ন: বিক্রম আপনার জীবনে ‘অমরসঙ্গী’ কবে আসবে?
বিক্রম: (হেসে) সোহিনী বলেছে খুঁজে দেবে।
সোহিনী: (বিক্রমের দিকে তাকিয়ে) ঘটকালিও করতে হবে দেখছি (হাসি)। খুব চাপের বিষয়। বিচ্ছেদ হলে তার পর দেখব, মাঝরাতে আমাকে ফোন করছিস!
বিক্রম: দেখুন, যখন এমন কোনও মানুষ আমার জীবনে প্রবেশ করবেন, যাঁর সঙ্গে আমি থেকে যেতে পারব— আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারব।
সোহিনী: আমার আর শোভনের ক্ষেত্রেও কিন্তু সেটাই ঘটেছে। শোভন আমার থেকে বয়সে ছোট। আমাদের খুব ভাল আলাপই ছিল না। তার পরে কোথা থেকে কী হল— বোঝার আগেই কিন্তু আমরা একসঙ্গে পথচলা শুরু করলাম। আমার মনে হয়, সব সম্পর্কে একটা স্পার্ক থাকে।
বিক্রম: সোহিনী ঠিকই বলেছে। আমার জীবনেও সে রকম একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় রয়েছি।