ঋতুপর্ণা-ফেরদৌস। ছবি: সংগৃহীত।
রাজনীতির ময়দানে পা রেখেছেন বাংলাদেশি অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ। বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লিগের হয়ে তিনি ভোটে লড়বেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি। কিন্তু সময় বার করতে পারছিলেন না। মঙ্গলবার সকালে ঢাকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তখন তিনি গাড়িতে। ফোন ধরেই বললেন, ‘‘প্রচুর কাজ বাকি। ঝটপট প্রশ্ন শুরু করুন।’’
প্রশ্ন: মনোনয়ন ঘোষণার পর দু’দিন অতিক্রান্ত। চারপাশ থেকে কী রকম প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
ফেরদৌস: (হেসে) টানা ফোন বেজে চলেছে। আমি ভাবিনি আমাকে নিয়ে মানুষ এ রকম উচ্ছ্বাস দেখাবেন। আমার বন্ধু, সতীর্থ, প্রতিবেশী, নবীন-প্রবীণ রাজনীতিকেরা— প্রত্যেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। খুব ভাল লাগছে। আবার একটু ভয়ও লাগছে।
প্রশ্ন: কেন? ভয় কিসের?
ফেরদৌস: এই ভালবাসার প্রতিদান তো দিতে হবে! তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেখা যাক, যে সংকল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি, তার কতটা পূরণ করতে পারি।
প্রশ্ন: পঁচিশ বছরের অভিনয় জীবন। হঠাৎ করে রাজনীতির ময়দানে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
ফেরদৌস: আসলে আমার পেশা তো মানুষকে কেন্দ্র করেই। এক সময় কলকাতার বাইরে যখন শুটিং করতাম, বা এখন ঢাকার বাইরে শুটিং করার সময়েও প্রচুর মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। তাঁদের সুখ-দুঃখ কাছ থেকে দেখেছি। অভিনেতা হিসেবে একটা ছোট্ট কিছু করলেও তাঁদের মুখে হাসি ফুটতে দেখেছি। আমার সেটা খুব ভাল লাগে। তার পর যখন মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত হলাম, তাঁর সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে গেলাম, তখন দেখলাম কী সহজে উনি মানুষের সঙ্গে মিশে যান! ঢালিউডের (কলকাতার টলিউড বা মুম্বইয়ের বলিউডের মতোই চলতি নাম) শিল্পীদের যে কোনও বিপদে উনি পাশে এসে দাঁড়ান। তখন কিন্তু উনি সেই ব্যক্তি কোন দল কেন বা কোন আদর্শে বিশ্বাস করেন, সেটা দেখেন না। তাঁর কাছে দেশের ওই মানুষটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা দেখে আমারও মনে হয়েছিল এ রকম কিছু করার কথা।
প্রশ্ন: সেই ইচ্ছা থেকেই তা হলে?
ফেরদৌস: হ্যাঁ। প্রধানমন্ত্রী আমার উপর আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে খুব ভাল একটা কেন্দ্র (ঢাকা-১০) দিয়েছেন। এই আসনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। অভিজাত এলাকা। সেটাকে ঘিরে স্কুল, কলেজ, মন্দির-মসজিদ রয়েছে। উন্নত এলাকা। কিন্তু আমি তার পরেও চেষ্টা করব যথাসাধ্য কাজ করতে।
প্রশ্ন: প্রচারের কাজ শুরু করতে পেরেছেন?
ফেরদৌস: (হেসে) এখনও পুরোপুরি শুরু করতে পারিনি। সোমবার মনোনয়নপত্র হাতে পেয়েছি। এখন সরকারি কাজগুলো শেষ করছি। গতকাল (সোমবার) বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ামে মুজিবুর রহমানের ছবিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এই বাড়িতেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেড়ে ওঠা। সব মিলিয়ে ধানমন্ডির একটা আলাদা আবেগ রয়েছে। সেখান থেকেই শুরু করলাম আমাদের কর্মসূচি।
প্রশ্ন: আগামী দিনে রাজনীতি এবং অভিনয়ের মধ্যে কী ভাবে সমতা রাখবেন?
ফেরদৌস: (হেসে) বিগত ৮-১০ বছর আমি কিন্তু ছবির সংখ্যা কমিয়েছি। কেরিয়ারের শুরুতে তখন আমি দু-তিন শিফ্টে কাজ করতাম। এক সঙ্গে পাঁচটা ছবির শুটিংও করেছি। কলকাতা এবং ঢাকায় সমানতালে কাজ করেছি। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। সকলেই এখন বছরে একটা বা দুটো ছবি করেন। তাই মনে হয় না অসুবিধা হবে। ইচ্ছে থাকলেই তো উপায় বেরিয়ে আসে।
প্রশ্ন: আপনি অভিনয় থেকে অবসর নিতে পারেন বলেও আলোচনা শুরু হয়েছে।
ফেরদৌস: দেখুন, বছরে একটা বা দুটো ছবি করার ইচ্ছাই রয়েছে। দেশাত্মবোধক এবং সামাজিক বার্তা থাকবে এমন ছবিই করতে চাই। আবার কখনও যদি মনে হয় যে রাজনীতিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছি, তখন ধীরে ধীরে সুচিত্রা সেনের মতো অভিনয় থেকে সরেও দাঁড়াতে পারি। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ভবিষ্যতের উপর।
প্রশ্ন: রাজনীতিতে আসার পর শিল্পীদের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। বিষয়টাকে আপনি কী ভাবে দেখেন?
ফেরদৌস: আমি তা মানি না। অভিনেতা হিসেবে সব দর্শক নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ করবেন না। আবার যিনি আমাকে পছন্দ করেন, তিনি হয়তো অন্য কোনও নায়ককে পছন্দ করেন না। ছবি দেখতে গিয়ে শাহরুখ খান বা সলমন খানের মধ্যে কার ছবি দেখব, সেই সিদ্ধান্ত তো আমার। আমি যে দলের সমর্থক, তার বিরোধীরা হয়তো আমাকে নায়ক হিসেবে এতদিন পছন্দ করতেন। কিন্তু এ বার হয়তো তাঁরা একটু ক্ষুণ্ণ হতে পারেন। দেখুন, এক জন মানুষ তো পৃথিবীর সকলকে খুশি করতে পারবে না। কিন্তু যাঁদের কাছে আমি রোল মডেল, তাঁদের জন্য তো আমাকে কিছু করতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তো সেটা আমার অধিকার।
প্রশ্ন: খুলনার ‘মাগুরা-১’ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশের নামী ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান। ওঁর সঙ্গে কোনও কথা হয়েছে?
ফেরদৌস: এখনও কথা হয়নি। এমনিতেই আমরা খুব ভাল বন্ধু। শাকিব নিশ্চয়ই এখন ওঁর কেন্দ্রে ব্যস্ত। মাশরফিও (বাংলাদেশের প্রাক্তন জোরে বোলার মাশরফি মোর্তাজা। এখন আওয়ামী লিগের সাংসদ) আমার খুব ভাল বন্ধু। জাতীয় দলের দুই ক্যাপ্টেনই এখন জনপ্রতিনিধি হতে চলেছেন, এটা ভেবেই ভীষণ গর্ববোধ করছি। আশা করছি ওঁদের দু’জনের সঙ্গেই জলদি দেখা হবে।
প্রশ্ন: আপনার মতে ভোটের ময়দানে তারকা প্রার্থী দেওয়ার কী কী সুবিধা রয়েছে?
ফেরদৌস: মানুষটি তো ইতিমধ্যেই তৈরি। তাঁকে সকলে চেনেন। তাঁর কাজ নিয়েও সকলের একটা ধারণা থাকে। তাই অনেকটাই সুবিধা হয়। কলকাতাতেও তো অনেকেই অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতিতে রয়েছেন। আপনি ভাবমূর্তির কথা বলছিলেন। আমি যদি অন্যায়ের পথে যাই, তা হলে নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হবে। কিন্তু আমি ভাল কাজ করলে নিশ্চয়ই তখন আর ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। আসলে উদাহরণ দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু উদাহরণ হয়ে ওঠা খুব, খুব কঠিন। আর আমি সব সময়েই চেয়েছি উদাহরণ হতে।
প্রশ্ন: ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আপনি এবং অভিনেতা গাজি আব্দুন নুর পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের হয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে বিতর্কের শিকার হন। আর এখন আপনি নিজেই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চলেছেন। মনে আছে সেই ঘটনা?
ফেরদৌস: আমি এখনও ওই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করি। কারণ, আমি তখন নিয়মকানুন জানতাম না। কলকাতায় দীর্ঘ দিন কাজের ফলে আমি দুই বাংলারই কাছের মানুষ। যাঁরা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরাও হয়তো আবেগের বশবর্তী হয়ে বিষয়টা ততটা খেয়াল করেননি। আমার বিরুদ্ধে তার পরে বিরোধী পক্ষ অভিযোগ আনল।
প্রশ্ন: তার পর তো আপনাকে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতাতেও পড়তে হয়েছিল।
ফেরদৌস: হ্যাঁ। কলকাতাকে সব সময়েই আমি দেশের বাইরে আমার দেশ হিসেবে দেখেছি। সেখান থেকেই প্রায় দু’বছর আমি দূরে ছিলাম। একাধিক ছবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। ওই একটা ভুলের জন্য আমাকে প্রচুর ভুগতে হয়েছে।
প্রশ্ন: টলিউডে আপনার প্রচুর বন্ধু রয়েছেন। এখনও পর্যন্ত কারা শুভেচ্ছা জানালেন?
ফেরদৌস: অনেকেই। ঋতুপর্ণা (সেনগুপ্ত) আমার খুব ভাল বন্ধু। ও তো বলেছে প্রয়োজনে ঢাকায় এসে আমার জন্য ভোটের প্রচারও করবে। (হাসতে হাসতে) কিন্তু তার পর আমি ওকে আমি কলকাতায় যে কাণ্ড ঘটিয়েছিলাম, সেটা মনে করিয়ে দিলাম!
প্রশ্ন: ভোটে জিতলে প্রথমেই কোন কোন কাজগুলো করার ইচ্ছা রয়েছে?
ফেরদৌস: এখনও কর্মসূচি চূড়ান্ত নয়। আমার কেন্দ্রের মেয়র শেখ ফজ়লে নুর তাপস আগে এখানকার সাংসদ ছিলেন। উনি এই কেন্দ্রকে আমার থেকে আরও ভাল চেনেন। ওঁর নেতৃত্ব এবং সাহায্যেই আমরা আমাদের নির্বাচনী ইস্তাহার এবং পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করব। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে এখন প্রচুর উন্নয়ন হচ্ছে। আগামী দিনে ওঁর থেকে নিশ্চয়ই একাধিক নির্দেশ পাব। তবে আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার আবশ্যিক শর্ত। আমি এই দুটো ক্ষেত্রে আগে কাজ শুরু করতে চাই।