(বাঁ দিকে) স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে বাবুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ভাই স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে বাবুনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করার কথা জানিয়ে দিলেন তৃণমূলনেত্রী তথা তাঁর দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার মমতা ছিলেন শিলিগুড়িতে। সেখানে একটি সাংবাদিক বৈঠকে তিনি জানান, বাবুনের সঙ্গে তাঁর বা তাঁর পরিবারের আর কোনও সম্পর্ক নেই। হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হতে না পেরে বাবুন যা করছেন বা বলছেন, তাতে গোটা বন্দ্যোপাধ্যায়-পরিবার ক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন মমতা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বুধবার মমতা বলেন, ‘‘আমি যে দিন থেকে দল করি, কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে কাজ করি। আমার পরিবার বলে কিছু নেই। মা, মাটি, মানুষই আমার পরিবার। আমাদের পরিবারে রক্তের সম্পর্কে ৩২ জন সদস্য। কেউ এ রকম নয়। এতে সবাই ক্ষুব্ধ।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘আমি সরাসরি বলছি, যারা বেশি বড় হয়ে যায়, তাদের লোভও বেড়ে যায়। ওকে পরিবারের সদস্য বলেই আমি মনে করি না। সব সম্পর্ক ছেদ।’’
মমতা এ-ও জানিয়েছেন, বাবুনের অনেক কাজ নিয়েই তিনি দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষুব্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘ওর অনেক কাজই আমি অনেক দিন ধরে পছন্দ করি না। কিন্তু সব কথা তো বাইরে বলা যায় না। আজ বলছি।’’ পাশাপাশি মমতা আরও বলেন, ‘‘যে যেখানে খুশি যেতে পারে। স্বাধীন ভাবে ভোটে দাঁড়াতে পারে। তবে হাওড়া সদরে তৃণমূলের প্রার্থী, জোড়াফুলের প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ই। অন্য কেউ নয়।’’
মঙ্গলবার থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার ছোট ভাই বাবুনের বিজেপিতে যোগদান করা নিয়ে নানা জল্পনা ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছিল রাজনীতির অলিন্দে। এরই মধ্যে হঠাৎ বাবুন দিল্লি চলে যাওয়ায় সেই জল্পনা আরও বেশি করে দানা বাঁধে। বাবুন নিজে এক পরিচিতের চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে এসেছেন বলে জানালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে বাবুন দেখা করবেন অলিম্পিক্স সংস্থার প্রাক্তন সহ-সভাপতি নরেন্দ্র বাত্রার সঙ্গে। যিনি বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এই নিয়ে যখন লোকসভা ভোটমুখী বাংলায় আলোচনার পারদ চড়তে শুরু করেছে, তখনই সেই জল্পনা নাকচ করেছেন বাবুন। তবে একই সঙ্গে তিনি জানান, বিজেপিতে না গেলেও নিজের দল যে ভাবে তাঁর পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তাতে অভিমান হয়েছে।
বুধবার সংবাদমাধ্যমে স্বপন জানান, তিনি বিজেপিতে যাচ্ছেন না। তবে দলের প্রার্থিতালিকা দেখে অভিমান হয়েছে তাঁর। কারণ সেখানে প্রার্থী করা হয়েছে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যাঁকে তিনি অপছন্দ করেন এবং একই সঙ্গে মনে করেন, তিনি লোকসভা ভোটের প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নয়। কারণ প্রসূন এলাকার উন্নয়ন খাতে নিজের সাংসদ তহবিলের বরাদ্দটুকুও শেষ করতে পারেননি। প্রসূন সম্পর্কে যে তাঁর ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন মমতার ভাই।
গত কয়েক বছর ধরেই বাবুন হাওড়ার ভোটার। এ-ও ঠিক যে, হাওড়া তৃণমূলের মধ্যে বাবুনের প্রার্থী হওয়া নিয়ে জল্পনা ছিল। কিন্তু মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ বারও প্রসূনকেই প্রার্থী করেছেন। আর তাতেই ক্ষুব্ধ বাবুন। গত রবিবার ব্রিগেডের মঞ্চে ছিলেন বাবুন। ডেনিম ব্লু জিন্স, হাফ-হাতা লম্বা ঝুলের সাদা পাঞ্জাবি এবং চোখে বড় রোদচশমা পরে সভা শুরুর অনেক আগে থেকেই মঞ্চে বিবিধ বিষয় তদারকি করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সেই মঞ্চ থেকেই আসন্ন লোকসভা ভোটে হাওড়া সদরের প্রার্থী হিসাবে প্রসূনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল শাসকদলের তরফে।
ভাইয়ের এহেন আচরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ মমতা ছোটবেলার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। দিদি বলেন, ‘‘ও ছোটবেলার কথা ভুলে গিয়েছে। বাবা যখন মারা গেল, ওর তখন আড়াই বছর বয়স। আমি আমার পরিবারের সবাইকে মানুষ করেছি। দুধের ডিপোয় কাজ করে ৪৫ টাকা পেতাম। তার পর আমি রাজনীতি করতে শুরু করি। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের সব ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছা হয়। কাউন্সিলর, এমএলএ, এমপি— সব ভোটে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু আমি পরিবারতন্ত্র করি না। মানুষতন্ত্র করি। লোভীদের আমি পছন্দ করি না।’’
বাবুন ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, প্রসূনের উপর তাঁর রাগ অনেক দিনের। মোহনবাগান ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রসূন তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করেছিলেন, তা তিনি কখনও ভুলবেন না বলেও জানিয়েছেন মমতার ভাই। তবে বাবুনের এহেন বক্তব্য নিয়ে বুধবার দুপুর পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করেননি প্রসূন। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ রয়েছে। মোবাইলে পাঠানো বার্তারও কোনও জবাব মেলেনি। তবে তাঁর আপ্তসহায়ক জানিয়েছেন, হাওড়ার বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। যা বলার, পার্টি বলবে।
সকালে তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, বাবুন যা করছেন, তা বাজার গরম করার জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘বাবুন ময়দানে বিভিন্ন সংস্থায় যত পদ আঁকড়ে রয়েছেন, তা দিদির পরিচয় ভাঙিয়েই। বিজেপিতে গেলে এক দিনে ওর সব পদ চলে যাবে।’’ মমতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি এবং তাঁর পরিবার আর ভাইয়ের পাশে নেই। যা সামগ্রিক ভাবে তৃণমূলেরই অবস্থান।