রাহুল সিংহ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সুকুমার রায় তাঁর ‘সৎপাত্র’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে, ঘায়েল হয়ে থামল শেষে।’ সেই বলায় ব্যঙ্গ ছিল। কিন্তু মোট ন’বার ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে-যাওয়া রাহুল সিংহকে নিয়ে শ্রদ্ধাই প্রকাশ করছেন রাজ্য বিজেপির নেতারা। সমালোচনা যে একেবারে নেই, তা-ও নয়। অনেকেই বলেন, দু’বার রাজ্য সভাপতি হয়েছেন। সর্বভারতীয় দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু ভোটে জিততে পারেননি কখনও। যদিও রাহুল নিজে এমন সমালোচকদের ‘মূর্খ’ এবং ‘ভণ্ড’ মনে করেন। আর তাঁর দীর্ঘ দিনের সহকর্মী শমীক ভট্টাচার্য মনে করেন, ‘‘রাহুল সিংহ নেতা ছিলেন। নেতা আছেন। নেতা থাকবেন।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘রাহুলদা যখন ভোটে হেরেছেন, তখন বিজেপির হয়ে কেউ লড়তেই চাইত না। হার নিশ্চিত জেনেও ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান’ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বার বার তিনি প্রকৃত নেতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে লড়াইয়েরই ফল মিলছে এখন।’’
১৯৮০ সালে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপির জন্ম। সেই সময়েই ১৯৬৩ সালে জন্ম নেওয়া রাহুল বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৭। আরএসএসের নিয়মিত স্বয়ংসেবক রাহুল বাংলায় বিজেপির গোড়ার সময় থেকে টানা ৪৪ বছর দলের সঙ্গে রয়েছেন। এখন তাঁর উপরে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু তাতে দলের রাজ্য দফতরে তাঁর উপস্থিতিতে খামতি নেই। মধ্য কলকাতার মুরলীধর সেন লেন থেকে রাজ্য দফতর সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে চলে গেলেও নিয়ম করে হাজিরা দেন তিনি। সেটাও আবার নির্ধারিত সময়ে। পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে রাহুল বলেন, ‘‘আমি বরাবর সময়ানুবর্তিতায় জোর দিই। দলের কাজে আরও বেশি করে। এক বার সভা করতে জেলায় গিয়ে দেখি, তখনও মঞ্চ বাঁধা চলছে। নেতাদের সে কী লজ্জা! তাঁরা ভাবতেই পারেননি, ঘড়ি ধরে কোনও নেতা সভায় চলে আসবেন। এখনও সেটা মেনে চলার চেষ্টা করি।’’
২০১৫ সালে রাজ্য বিজেপির সভাপতি হন দিলীপ ঘোষ। তার আগে ২০১৪ সালেই বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে একক শক্তিতে খাতা খুলে ফেলেছে বাংলায়। জোট গড়ে দার্জিলিঙে ২০১৪-র আগে ২০০৯ সালেও জয় এসেছিল। তবে ২০১৪ সালে একক শক্তিতে আসানসোলে প্রথম বার পদ্ম ফোটে বাংলায়। আরও আগে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন তপন সিকদার, সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তখন তৃণমূলের সঙ্গে জোট ছিল। একক ভাবে বিজেপির প্রথম জয় ২০১৪ সালে। সে বার রাহুলও প্রার্থী হয়েছিলেন। নিজে না জিতলেও দল দুই সাংসদ পেয়েছিল। রাহুল বলেন, ‘‘সে বার আমরা একক শক্তিতে জিতেছিলাম শুধু আসানসোলে। কারণ, দার্জিলিঙে জোট ছিল আমাদের।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমি বার বার হেরেছি বলেন যাঁরা, তাঁদের সম্পর্কে আমার একটাই কথা। তাঁরা হয় মূর্খ, নয় ভণ্ড। কারণ, আমি যে সময়ে ভোটে লড়েছি সেই সময়টা ছিল আলাদা। বলা যেতে পারে, আমি হেরেছি দু’বার। ২০১৯ এবং ২০২১ সালে। তারও নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।’’
নির্বাচনী রাজনীতিতে রাহুলের পদার্পণ ১৯৯৮ সালে। রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে প্রার্থী হননি। তবে ২০০১ সালে উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘি বিধানসভা আসন এবং ২০০৪ সালে মেদিনীপুর লোকসভা আসনে প্রার্থী হন। এর পরে আবার ২০০৬ সালে জগদ্দল বিধানসভা এবং ২০০৯ সালে বাঁকুড়া লোকসভা আসনে প্রার্থী হন। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের বছরে প্রার্থী হননি রাহুল। তখন তিনি রাজ্য বিজেপির সভাপতি। এর পরে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পর পর দু’বার কলকাতা উত্তর লোকসভা আসন থেকে প্রার্থী হন। মাঝে ২০১৬ সালে জোড়াসাঁকো বিধানসভা এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে হাবড়া বিধানসভা আসনে প্রার্থী হন। কোনও বারেই জয় পাননি।
এই লোকসভা ভোটে তাঁকে প্রার্থী করেনি দল। তা নিয়ে একটু ‘আক্ষেপ’ থাকলেও রাহুল-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ‘‘রাহুলদা এ বার স্বস্তিতে। জেতার চাপ বা হারার ভয় নেই। বরং দলকে জেতানোর জন্য লড়াইয়ের মঞ্চ রয়েছে গোটা রাজ্যে।’’
এত হার নিয়ে তত ‘অস্বস্তি’ নেই রাহুলের। বরং অসময়ে দলের পতাকা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যতের জমি তৈরি করার অহঙ্কার রয়েছে। যদিও সে অহঙ্কার তিনি প্রকাশ করেন না। তবে আফসোস রয়েছে শেষ লড়া দু’টি ভোটে হার নিয়ে। রাহুল বলেন, ‘‘গত লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা উত্তরে আমার জয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু প্রচারের শেষ দিনে অমিত শাহজির রোড-শোয়ের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার চক্রান্ত সব শেষ করে দেয়। গত বিধানসভা নির্বাচনেও হাবড়া আসনে গণনায় কারচুপিতে বিজেপি হারে।’’
বিজেপির এখনকার চেহারার সঙ্গে কোনও মিলই ছিল না আশি কিংবা নব্বই দশকের। বিজেপির তাত্ত্বিক নেতা এবং সুবক্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন হরিপদ ভারতী। তিনিই রাজ্য বিজেপির প্রথম সভাপতি। ভোটে জিতেছিলেন এক বার। ১৯৭৭ সালে। বিজেপির জন্মের আগে জনতা পার্টির টিকিটে জোড়াবাগান বিধানসভা থেকে। তার আগে জনসঙ্ঘের টিকিটে হেরেছিলেন কলকাতা উত্তর-পশ্চিম আসনে। জনতা পার্টির টিকিটে হেরেছিলেন যাদবপুরে। বিজেপির টিকিটে কোনও দিনই জিততে পারেননি। সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে শমীক বলেন, ‘‘প্রবাদপ্রতিম বাগ্মী ছিলেন হরিপদ ভারতী। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং আচার্য দেবীপ্রসাদ ঘোষের পর তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব বিজেপিতে আসেননি। আসবেনও না। তিনিও তো নির্বাচনে জেতেননি! তাতে কি কৃতিত্ব কমে?’’ প্রসঙ্গত, হরিপদ ভারতী এত বার হেরেছিলেন যে, বিরোধীরা তাঁকে ‘হেরোপদ ভারতী’ বলে কটাক্ষ করতেন।
একই অবস্থা হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী তপন সিকদারেরও। মালদহের ভূমিপুত্র তপন ইংরেজবাজার বিধানসভায় একাধিক বার পরাজিত হয়েছেন। দমদম লোকসভা নির্বাচনে পর পর তিন বার হেরেছেন। তবে মানুষ মনে রাখে পর পর দু’বার ১৯৯৮ এবং ’৯৯ সালে তাঁর জয়ের কথা। যা শুনে রাহুল বললেন, ‘‘আমিও এক বার জিতে গেলে মানুষ পুরনো হারের কথা মনে রাখত না।’’
দল এ বার প্রার্থী করেনি রাহুলকে। আবার হারতে হবে না বলে কি তিনি স্বস্তিতে? না কি ক্ষুব্ধ? রাহুল বলছেন, ‘‘রাজনীতিতে স্বস্তি বা ক্ষোভের কোনও জায়গা নেই। দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। আমি তো চিরকাল দলকেই জীবন বলে ভেবে এসেছি।’’
রাহুলের মতো শমীকও হার দেখেছেন। গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি হেরেছিলেন। তবে তিনিই বিজেপির প্রথম একক ভাবে জয়ী বিধায়ক। বসিরহাট দক্ষিণ আসনে ২০১৪ সালে জিতেছিলেন শমীক। সদ্য তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে দল। শমীক বলেন, ‘‘এখন বিজেপির সুসময়। অনেকে আসছেন। কিন্তু রাহুলদা তো বটেই, আমিও অনেক কঠিন সময়ে দল করেছি।’’ শমীক আরও বলেন, ‘‘আমরা যে সময়ে বিজেপি করেছি, তখন স্লিপার ক্লাসের টিকিট কাটারও পয়সা ছিল না। এক বার আমি আর রাহুলদা কৃষ্ণনগরে গিয়েছিলাম। কর্মসূচির শেষে কোনও দোকান খোলা নেই। একটা মিষ্টির দোকানে খাবার পেলাম। কিন্তু সঙ্গে থাকা একটি মাত্র ৫০ টাকার নোট ছেঁড়া! দোকানদার খাবার দিয়েও ফেরত নিয়ে নিলেন। শেষে দু’জনে পেট ভরে টিউবওয়েলের জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম পার্টি অফিসের মেঝেয়।’’
পদ্মশিবিরে কান পাতলে শোনা যায়, বিভিন্ন বিষয়ে অনেক সময় রাহুল-শমীকের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। তবে রাহুল সম্পর্কে শমীক এখন শ্রদ্ধাবনত। বললেন, ‘‘এখনও দলের কাজে ওঁর কোনও ক্লান্তি নেই। আমার চোখে উনি সবসময়ের নেতা। অনেকেই জানেন না, বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই দলের কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন রাহুলদা। গ্রামে-গঞ্জে থেকে কাজ করেছেন।’’
কিন্তু ভোটে জিততে পারেননি।
এখন দলের ভাল সময়। তিনি কি একটি নিশ্চিত আসন পেয়ে জয়ী হতে চেয়েছিলেন? রাহুলের জবাব, ‘‘সংগঠনে কিছু চাইতে নেই। যা পাওয়ার পেয়েছি। আরও কিছু পাওয়ার থাকলে পাব।’’ রাহুল-ঘনিষ্ঠেরা অবশ্য বলেন, এ বার তাঁকে টিকিট না দিয়ে ঠিক করেনি দল। তবে রাহুল কোনও বিতর্ক তৈরি করেননি।
সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন এক বারই। রাজ্য সভাপতি পদের মেয়াদ ফুরোনোর পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক হন রাহুল। কিন্তু ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বভারতীয় পদাধিকারীর তালিকায় তাঁর পরিবর্তে জায়গা পান তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা অনুপম হাজরা। ওই ঘটনায় রাহুল প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানান। তবে খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলে নেন। যেমন এ বারেও। নইলে কি সদ্য উত্তরবঙ্গের প্রচার সেরে কলকাতায় ফেরা রাহুল বলতেন, ‘‘ব্যক্তি নয়, সকলের আগে সংগঠন। এটা মানি বলেই বিজেপি করি।’’