RG Kar Protest

আরজি কর-কাণ্ডের জের! ‘মানুষ’ হওয়ার সহজপাঠ দিতে আগ্রহী বহু স্কুল

নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষা দিতে বিভিন্ন স্কুলে কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি, পজ়িটিভ ম্যাসকিউলিনিটি বিষয়েও পাঠদান শুরু হয়েছে।

Advertisement
স্বর্ণালী তালুকদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৪
Image of Co-ed school students taken from internet.

প্রতীকী চিত্র।

আরজি কর-কাণ্ডের ছায়া রাজ্যের শিক্ষাসমাজেও। সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি, পড়ুয়া থেকে শিক্ষক— কালো ব্যাজ পরে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার জন্য সকলেই শিক্ষক দিবসকে বেছে নিয়েছিলেন। নীরব প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনগুলিও।

Advertisement

তবে প্রতিবাদ, নীরবতা পালনেই সীমাবদ্ধ নেই শিক্ষা মহল। বিভিন্ন স্কুলের তরফে নৈতিকতা, মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এই মর্মে যাদবপুর বিদ্যাপীঠের তরফে পজ়িটিভ ম্যাসকিউলিনিটি বিষয়ক একটি বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে স্কুলের ছাত্রদের শেখানো হয়েছে, পুরুষ হিসাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কী ভাবে ব্যবহার করা উচিত, বিশেষত মহিলাদের সঙ্গে কেমন ভাবে কথা বলতে হবে, বা কোন পরিস্থিতিতে কোন কাজটা করতে হবে।

এই বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেন, “সাম্প্রতিক ঘটনার প্রভাব দেখা গিয়েছে স্কুলের পড়ুয়াদের মধ্যেও। পুঁথিগত শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ছেলেদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের জাগরণ হওয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে আমরা এই বিশেষ কর্মসূচির আয়োজন করেছিলাম। ভবিষ্যতের স্কুলের শিক্ষকরাও একই ভাবে এই ধরনের বিষয় শেখানোর চেষ্টা করবেন, যাতে ছেলেদের মধ্যে পুরুষত্ব নিয়ে কোনও ভুল ধারণা তৈরি না হয়।”

Students of Jadavpur Vidyapith participated in teacher's day and special workshop.

শিক্ষক দিবস এবং বিশেষ কর্মশালায় শামিল যাদবপুর বিদ্যাপীঠের পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।

বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুলগুলিতে পজ়িটিভ ম্যাসকিউলিনিটির শিক্ষাদান কতটা প্রাসঙ্গিক? যোধপুর পার্ক বয়েজ় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার জানিয়েছেন, সাহিত্যের উপাদানের সাহায্যে স্কুলের ছেলেদের এই বিষয়ে শিক্ষাদান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্কুলের ইংরেজির শিক্ষকরা আগেই একাদশ এবং দ্বাদশের পড়ুয়াদের ভার্জিনিয়া উলফের ‘আ রুম অফ ওয়ানস্ ওন’-এর বিষয়বস্তু শিখিয়েছিলেন, যাতে শিক্ষক দিবসের দিন ছাত্ররা মাধ্যমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের গল্পের মাধ্যমে পুরুষ এবং নারীদের সামাজিক অবস্থানের বিষয়গুলি বোঝাতে পারে। প্রসঙ্গত, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই বিশেষ প্রবন্ধটি একাদশের তৃতীয় সিমেস্টারের পাঠ্যক্রমে যোগ করা হয়েছে।

অমিত আরও বলেন, “ছেলেদের নিয়ে ক্লাস করাতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের অভাবের ছবি ধরা পড়েছে। সেই ছবি পরবর্তীকালে যাতে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কোনও অপরাধের জন্ম না দেয়, সেই লক্ষ্যেই এই অভ্যাস আমরা বজার রাখব। একই সঙ্গে ছাত্ররা নিজেরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দেওয়াল পত্রিকার মাধ্যমে সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করার আগ্রহ দেখিয়েছে।”

স্কুলের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন, এমনটাই মনে করেন হীরাপুর মানিকচাঁদ ঠাকুর ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষিকা নিবেদিতা আচার্য। তিনি জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত স্তরে কিংবা কাজের জায়গায় মেয়েদের তুলনায় পুরুষরা অনেক বেশি সক্ষম— এই ধরনের ভাবনা ছোট থেকে মেয়েদের খানিকটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ঘরে বসিয়ে রাখা বা কিশোরীদের বিয়ে দেওয়ার মতো সমস্যা এখনও বর্তমান। তাই স্কুলের তরফে মেয়েদের শেখানো হয়, পরিবারে তার গুরুত্ব কতটা এবং সে তার দাদা বা ভাইয়ের মতোই শিক্ষিত হয়ে কাজ করতে সক্ষম। এ বিষয়ে নিয়মিত ভাবে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা এবং প্রয়োজনে অভিভাবকদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়ে থাকে।

Students of Aditya Academy Senior Secondary School participated in the special program of Independence Day.

স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ কর্মসূচিতে শামিল আদিত্য অ্যাকাডেমি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের পড়ুয়ারা। ছবি: বিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত।

তবে বিষয়টি পুরুষত্বের সঠিক ব্যবহার বা নারী সুরক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলেই মনে করেন আদিত্য অ্যাকাডেমি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের প্রিন্সিপল মেঘনা ঘোষাল। তিনি বলেন, “সার্বিক ভাবে সঠিক মানুষ হয়ে ওঠা এবং একে অপরকে সম্মান করার শিক্ষাদান ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে পড়ুয়ারা যথেষ্টই বিচলিত। সেই পরিস্থিতিতে বার বার তাদের মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, ভয় পেলে চলবে না, বরং একসঙ্গে থেকে, হাতে হাত মিলিয়ে চলতে হবে, যাতে তারা দেশকে বিশ্বের দরবারে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দের মতো সমাজ সংস্কারকদের দেখানো পথে চলতে হবে, তবেই সার্বিক ভাবে মানসিকতার বিকাশ হওয়া সম্ভব।”

স্কুল স্তরে শিক্ষাদানের পাশাপাশি, পারিবারিক পরিবেশেও একই বিষয়ের সমন্বয় থাকা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেন বেথুন কলেজের উইমেন স্টাডিজ় সেন্টারের ডিরেক্টর এবং মনোবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নীলাঞ্জনা বাগচী। তাঁর মতে, স্কুলে যা শেখানো হচ্ছে, তার বিপরীত প্রতিফলন যদি বাড়িতে দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে সেই ছাত্র বা ছাত্রী বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদেরও এই ধরনের কর্মসূচিতে শামিল করা প্রয়োজন রয়েছে। এতে উগ্র পৌরুষ বা নারী অবমাননার ঘটনাগুলি নিয়ে পড়ুয়াদের পাশাপাশি অভিভাবকদের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement