ফাইল চিত্র।
দশচক্রে ভগবান ভূত হইতে পারে, বহুজনের ধারণায় মিথ্যাকে সত্য বলিয়া চালানো যাইতে পারে, কিন্তু তাহা যথার্থ সত্য হইয়া উঠে না, ফেসবুকের অধীশ্বর বলিলেও না। সমাজমাধ্যমের ব্যবসাবুদ্ধি সমাজে ঘৃণার প্রকোপ বাড়াইতেছে— এই অভিযোগকে মার্ক জ়াকারবার্গ ‘অযৌক্তিক’ বলিয়া ফুৎকারে উড়াইয়া দিয়াছেন, কিন্তু অভিযোগটি উড়িবার নহে। তাঁহার সংস্থার ভূতপূর্ব কর্মী ফ্রান্সেস হগেন ইতিমধ্যে তাহার কার্যকলাপ সম্পর্কে বিভিন্ন উদ্বেগজনক ‘তথ্য’ প্রকাশ করিয়া যে শোরগোল তুলিয়াছেন, এই অভিযোগটিও তাহার অঙ্গ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিশেষ কমিটির প্রশ্নের উত্তরে হগেন জানাইয়াছেন, সমাজমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের তাড়নায় সামাজিক বিভাজন বাড়ে। সেই প্রক্রিয়ার দুইটি দিক। এক দিকে, পরস্পরবিরোধী মতামতের অনুসারীরা এককাট্টা হইয়া আরও বেশি মাত্রায় পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন; অন্য দিকে, যাঁহাদের মত কিছুটা মধ্যপন্থী ছিল তাঁহারা চরমপন্থী হইয়া উঠেন। অর্থাৎ, ব্যক্তির মতামত আরও অনমনীয় হয় এবং অনমনীয় ব্যক্তিরা আপন শিবিরে আরও সংগঠিত হন। সমাজমাধ্যমের চালকরা এই প্রক্রিয়াটিকে সচেতন ভাবে চালাইতেছেন কি না, এই দ্বিমাত্রিক বিভাজন তাঁহাদের ব্যবসায়িক মডেলের অঙ্গ কি না, সেই বিষয়ে তর্ক ও গবেষণা চলিতে পারে, কিন্তু অভিযোগে নিহিত আশঙ্কাটি কেবল যুক্তিযুক্ত নহে, প্রাসঙ্গিক।
সমাজমাধ্যমের ‘অবাধ’ পরিসরে বিরোধী এবং বিদ্বেষী শিবিরের সৃষ্টি ও প্রসারের সমস্যাটি বহু-আলোচিত। ‘ইকোসিস্টেম’ বা ‘ফিল্টার বাবল’ ধাঁচের শব্দবন্ধগুলি এই সমস্যার বাস্তব হইতেই উঠিয়া আসিয়াছে। এক ধরনের মত, ধারণা বা বিশ্বাসের অনুসারীরা এই পরিসরে কী ভাবে ক্রমাগত আপন আপন শিবিরে সংহত হইতেছেন এবং বিপরীত বা নিছক ভিন্নমতের অনুসারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণে তৎপর হইতেছেন, এক দশকের বেশি সময় ধরিয়া তাহা লইয়া গবেষণার অন্ত নাই, প্রতিকারের পথ খুঁজিবার চেষ্টাও চলিতেছে। রাজনীতির ভুবনে মেরুকরণের যে ভয়ঙ্কর মূর্তি দুনিয়ার বহু অঞ্চলে এবং ভারতে দেখা যাইতেছে, যাহার দাপটে উদার গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিপন্ন হইতেছে, তাহার পিছনে সমাজমাধ্যমের এই শিবির-বিভাজনী ভূমিকাটি স্পষ্টতই বিরাট।
কিন্তু ফ্রান্সেস হগেন সমস্যার অন্য যে দিকটির কথা বলিতেছেন তাহা তুলনায় কম আলোচিত হইলেও, কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। ব্যক্তির মতামত ক্রমশ চরম অবস্থানে সরিয়া যাইবার প্রবণতাটি বিভাজন ও মেরুকরণের অন্যতম পরিণাম, আবার তাহার এক উপকরণ তথা চালিকা শক্তি। মেরুকরণ বাড়িলে অনেকেই কোনও একটি শিবিরে নাম লিখাইতে প্রবৃত্ত হন, তাহার ফলে শিবিরগুলির আপন সংহতি ও অপরের প্রতি অসহিষ্ণুতাও তীব্রতর হয়। ইহা এক ধরনের পারস্পরিক অতিক্রিয়া। এই অতিক্রিয়াকে প্রতিহত করিতে না পারিলে উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, যে অন্ধকার বর্তমানকে দ্রুত গ্রাস করিতেছে। এই বিপদের মোকাবিলা সহজ নহে। সমাজমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের কল্যাণে তাহা আজ বহুগুণ বেশি কঠিন। সেই কঠিন কাজের প্রথম শর্ত অবশ্যই বহুমতের প্রতি আগ্রহ। সেই আগ্রহ সমাজে যত বাড়ানো যাইবে, ব্যক্তির মনে তাহার প্রতিষ্ঠা যত জোরদার হইবে, ‘চরমপন্থা’র আকর্ষণ ততই কমিবে, মেরুকরণও ততই দুর্বল হইবে। তাহা অসম্ভব নহে— নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে তেমন উত্তরণ দেখা গিয়াছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী জার্মানি তাহার একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু তাহার জন্য সমাজের সর্বস্তরে এবং সর্বক্ষেত্রে সুচিন্তার সংহতি অপরিহার্য। সমাজমাধ্যমের পরিসরটিকেও সেই সংহতির কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। দশচক্রে ভূত ভগবান হইতে পারে না, তাহাই বা কে বলিল?